প্রায় আধঘন্টা ধরেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রূম্পা আর রাফিদ। অনেক কথা বলবে ভেবে রাখা দুজনের কারোরই মুখে কোন কথা নেই। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে রুম্পার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে আর গলা শুকিয়ে কাঠ। রাফিদ হয়ত কিছুটা বুঝতে পেরেছে ওর অবস্থা তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দিল কিছুক্ষন। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রাত পেরিয়ে যাবে কিন্তু এই মেয়ের মুখ দিয়ে কথা বেরুবে না। নীরবতা ভাঙলো রাফিদ।
"মিলা।"
"জি?"
"আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলে কেন?"
এইবার ফ্যাসাদে পড়ল রূম্পা। কি বলবে সে নিজেই জানে না। তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে রইল।
"আজকেও চুপ করে থাকবে?"
রাফিদের কণ্ঠে আকুতি। কিন্তু রূম্পা তারপর ও কিছু বলতে পারলো না। কেউ যেন গলা চেপে ধরে আছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাফিদ আবার বলল,
"ঠিকাছে। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি কিছু কথা বলি মনযোগ দিয়ে শোন। "
রূম্পা এবার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো রাফিদের দিকে। তাকিয়েই যেন ভুল করে ফেলল। রাফিদ ওর দিকে এমন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েই ও যেন বিশ্ব সংসারের সকল অস্তিত্ব ভুলে গেল।।
"আমাদের প্রথম দেখাটা মনে আছে তোমার? তুমি ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার চোখে সেদিন ছিল ভয় আর অসহায়ত্ব। আমি সাহায্য করেছিলাম মানবতার খাতিরে সেটা ঠিক কিন্তু তোমার চেহারার মায়া আর চোখের সারল্যটুকু ঐপরিস্থিতিতেও আমার চোখ এড়ায়নি। রাতে যখন তোমাকে হাসপাতালে দেখলাম তুমি পরিচিত মহলের একজন এবং চাইলেই তোমার সাথে যোগাযোগ করা যাবে এটা ভেবে সেদিন ভীষণ শান্তি লেগেছিল তবে কেন এমন ফিলিংস হয়েছিল আমি ঠিক জানি না। এরপর সোশ্যাল সাইটে তোমাকে খুঁজে বের করা, মাঝেমধ্যে নক দেয়া এগুলো সবই আমার ইচ্ছাকৃত। নিজেকে যেন দমিয়ে রাখতেই পারতাম না। এতোটা ছেলে মানুষি, এতোটা ভাবাবেগ এর আগে আমার আর অনুভূত হয়নি। তুমি রিপ্লাই না দিলেও ম্যাসেজ সিন করেছ এটা দেখতেও ভালো লাগত। এরপর একদিন মনে হল আমি তোমাকে বিরক্ত করছি না তো? এটা ভাবতেই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। তাছাড়া, তোমার প্রতি অযথা একটা সুক্ষ্ম টান কাজ করছিল কিন্তু সেটা কেন করছিল এটা তখনো আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। এরপর আন্টির অসুস্থতার সময় তুমি যেদিন আমাদের বাসায় ছিলে সেদিন রিমির ঘরে ঘুমন্ত তোমাকে দেখে আমি ভেতরে ভেতরে বেশ বেসামাল হয়ে পড়লাম। সেদিনই বুঝলাম মনের কোণায় তুমি আস্তানা গেড়েছ। অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবার পর ওদিকে পড়াশুনা, কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু বিশ্বাস করবে কি না জানি না যোগাযোগ না করলেও এক মুহুর্তের জন্যেও আমি তোমাকে ভুলে যাই নি। "
একটানা কথাগুলো বলে রাফিদ থামলো। রূম্পা এখনো চুপচাপ। রাফিদের কথাগুলো ওর মনের কোথাও একটা ঝড় তুলে দিয়েছে। ভেতরে ভেতরে বেসামাল হয়ে পড়ছে। তবু প্রাণপণে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে রাফিদ আবার বলতে শুরু করল।
"মিলা, এতদিন আমি আমার অনুভূতিগুলো নিয়ে যথেষ্ট কনফিউজড থাকলেও এবার আমার মধ্যে আর কোন কনফিউশান নেই। কাল আমি চলে যাবো। এবার হয়ত হুট করে আর আসা হবে না বা খুব শীঘ্রই আসা সম্ভব হবে না। তাই যাবার আগে আমি আমার ফিলিংসটা জানিয়ে যেতে চাই আর তোমার কাছ থেকে ও একটা উত্তর চাই।"
এই কথাটা বলেই রাফিদ ঘুরে রুম্পার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তারপর বলল,
"শুরুতেই বলে রাখি এই কথাগুলো বলার সিদ্ধান্ত আমি এমনি এমনি নিইনি। এবার দেশে আসার পর আমার মনে হয়েছে আমার মত একইরকম কিছু অনুভূতি তোমার মধ্যেও কাজ করছে। একারণেই কথাগুলো বলা। নইলে তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলার কোন উদ্দেশ্য ছিলনা আমার। "
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল রাফিদ। তারপর দুইহাত বুকের উপর ভাঁজ করে বুক টানটান করে দাঁড়ালো রুম্পার সামনে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, "রুদমিলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। "
এই বাক্যটা শুনেই রূম্পা চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনের ভেতর একশগুণ বেগে বইতে থাকলো ফাগুন হাওয়া। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছিল ভালোলাগার আবেশ।
"আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তোমাকে আমার পাশে চাই। চাইলেই অনেকভাবেই পাশে থাকা যায়। কিন্তু আমি তোমাকে আমার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে আজীবন আমার পাশে চাই।" বলে রাফিদ রুম্পার দিকে তাকালো।
"তুমি কিছু বলবে না? আমিতো কাল চলে যাচ্ছি। যাবার আগে আমি তোমার কাছ থেকে শুনে যেতে চাই আমার জন্যে তোমার অনুভূতি কেমন। তুমিও কি তাই ফিল কর যা আমি করি? "
রাফিদের এই কথার প্রেক্ষিতে রূম্পা উপর নিচ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে জানালো সেও একইভাবে ফিল করে রাফিদের জন্য।
মুহুর্তেই রাফিদের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর বলল, "আজ তো ইশারায় কাজ হবে না। মুখ থেকে কিছু শুনবো আমি। "
এবার খুব আস্তে ধীরস্বরে রূম্পা বলল, "আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। "
রাফিদ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর চোখ খুলে রুম্পার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল,
"থ্যাঙ্কিউ মিলা। তুমি জানোনা এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি এই কদিন কি পরিমাণ টেনশনে ছিলাম। তুমি কি জবাব দেবে সেটা যেন মাথায় আসছিলোই না। "
" কেন? আপনিতো আমার মন পড়তে পারেন। এই ক্ষেত্রে আপনার টেলিপ্যাথি কোন কাজ করলো না? " কথাটা বলেই দুষ্টুমাখা হাসি দিল রূম্পা।
রাফিদ ও হেসে ফেলল।
" এইসব ক্ষেত্রে টেলিপ্যাথির উপরেই শুধু ভরসা করা যায় না। মানুষটার স্বীকারোক্তির প্রয়োজন হয়। আমার অস্থির হওয়ার কারণ ছিল একটাই আমি চলে যাবার পর যদি অন্যকেউ তোমার জীবনে চলে আসে? এই একটা চিন্তা আমাকে এইকদিনে একেবারে ঘায়েল করে ফেলেছে। তোমার পাশে আমি অন্যকাউকে কল্পনা করতেই পারি না। আমার সহ্যই হবে না। "
এইকথা শুনে রূম্পা মুখ টিপে হাসলো।
"মিলা, তোমার হাতটা একটু ধরতে দেবে?" আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল রাফিদ।
একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে কম্পনরত একটা হাত বাড়িয়ে দেয় রাফিদের দিকে। রাফিদ আলতোভাবে হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে নেয় আর অনুভব করতে থাকে প্রেয়সীর কাঁপুনি। ভীষণ ভালো লাগা আর প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় মন।
------------
সারারাত তেমন ভালো ঘুম হলো না রুম্পার। শেষ রাতের দিকে চোখ লেগে এসেছিল। একটু পরেই রওনা দেবে রাফিদ। সাথে যাবে তন্ময় আর আজিজুদ্দিন আহমেদ। ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো ভঙ্গিতে রুম্পাও রুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল রিমির পাশে। রুম্পাকে এতোটা আটপৌরে ভঙ্গিতে এই প্রথম দেখে রাফিদের খুব ইচ্ছা করছিল ওর ঘুমের রেশ মাখা ফোলা গালে টুপ করে একটা চুমু খেতে। আর এই গোপন ইচ্ছার কথা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পেলনা তার সদ্য হয়ে ওঠা প্রেমিকা।
তন্ময় এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি অফিসে চলে যাবে। রিমি ওর জন্য রেডি করে রাখা লাঞ্চবক্সটা নিয়ে আসতে গেল। জাহানারা আহমেদ ও স্বামীকে তাড়া দিতে রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই সুযোগে রাফিদ রুম্পার একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিল তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, "ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। আর অবশ্যই আমাকে মিস কোরো।"
রূম্পা লাজুক ভঙ্গিতে একটু হাসলো।
মাকে সালাম করে একহাতে রিমিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিল তারপর পাশে দাঁড়ানো রুম্পার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল, আসি। রূম্পা মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর রাফিদ বেরিয়ে গেল।
হঠাৎ রুম্পার মনে হল ওর পুরো পৃথিবীটা শূন্য হয়ে গেছে। এতটা শূণ্যতা আগে কখনো অনুভব করেনি। এই একটা অনুভূতি ওকে বুঝিয়ে দিল রাফিদ ছাড়া ও অসম্পূর্ণ। এই অনুভূতিগুলোই রাফিদ ওর মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল। যার কিছুই সে গতকাল রাফিদের সামনে ব্যক্ত করতে পারেনি। এখন ওর বেশ মন খারাপ লাগতে লাগলো।
রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। তারপর ম্যাসেঞ্জার ওপেন করে রাফিদের ইনবক্সটা ওপেন করল। আড়ষ্টহাতে টাইপ করল, "ভালোবাসি"। তারপর সেন্ড করে দিল।
নোটিফিকেশন পেয়ে রাফিদ ফোনস্ক্রিন অন করল। রুম্পার ম্যাসেজ দেখে অবাক হল। দ্রুত ওপেন করতেই চার অক্ষরের শব্দটা রাফিদের মনে ঝড় তুলে দিল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। বিড়বিড় করে আপন মনে বলল, "আমার স্বর্ণচাঁপা। "
----------------
ব্যাগ থেকে বিরাট এক বক্স চকলেট বের করে বন্ধুদের সামনে রাখলো অর্থী। একমাত্র রূম্পা ছাড়া বাকিরা বাচ্চাদের মত চকলেট খেতে ভীষণ ভালোবাসে। রুম্পার দাঁতের সমস্যার কারণে চকলেট খায় না। তেমন পছন্দ ও করে না। চকলেটের বাক্সটা পেয়ে সবাই হামলে পড়ল ওটার উপর। কিছু চকলেট অর্থী রুপমের জন্য আলাদা করে সরিয়ে রাখলো।
"চকলেটটা খেতে কি ভীষণ ভালো! কোত্থেকে কিনলি?" জানতে চায় মৃদু।
"ছোট ভাইয়া এনেছে। দুবাই থেকে।" বলল অর্থী।
কথাটা শোনা মাত্রই মৃদু বিষম খেল। কাশির দমকে চকলেট শ্বাস নালীতে ঢুকে যাবার উপক্রম হল। দ্রুত ওয়াটার বটলটা বের করে রূম্পা ওর দিকে এগিয়ে দিল।
সবাই তাকিয়ে আছে মৃদুর দিকে। ওর কাশি থামতেই যে যার মত স্বাভাবিক হয়ে গেল। মারুফের কথা শুনেই যে মৃদু এরকম বিষম খেল এই ব্যাপারটা কারো মাথায় আসলো না। তবুও মৃদু একবার চোরা চাহনি দিয়ে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।
"তুই খুব লাকি। দু দুটো ভাই আছে। ভীষণ আদর পাস নিশ্চয়ই। তোর বড় ভাইয়াতো পুরাই একটা মিষ্টি মানুষ। কি সুন্দর করে আমাদেরকে ছোট আপু ডাকে।" বলল সায়মা।
"হ্যাঁ, তা বলতে পারিস। এক দিক থেকে লাকিই বটে। বড় ভাইয়া ভীষণ সফট হার্টেড পার্সন। সবাই বলে ও একদম আম্মুর মত। আম্মুও নাকি এরকম কাইন্ড পার্সন ছিলেন। তবে ছোট ভাইয়ার ব্যাপারটা আলাদা। ও উপরে উপরে নিজেকে ভীষণ শক্ত দেখায়। কিন্তু ভেতরে একদম নরম। একটু মুডি অবশ্য। তাতে কি? দুই ভাই ই আমাকে খুব ভালোবাসে। প্রব্লেম হল এত ব্যস্ত থাকে দুজন। বড় ভাইয়া তাও দেশে থাকে বলে অন্তত দিনশেষে দেখা হয়। ছোট ভাইয়াতো আজকে দুবাই তো কালকে সিঙ্গাপুর। আব্বুর বাইরের বিজনেসগুলোত ও দেখাশুনা করে। আর আব্বুতো দেশে কম দুবাইতেই থাকে বেশি।
ঘরে আমার সময় কাটাবার লোক একটাই। হালিমা ফুফি। অবশ্য একা একা থাকতে থাকতে আমি এখন এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাঝেমাঝে আম্মুকে ভীষণ মিস করি। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে করে বাড়ি ফিরে আম্মুর কোলে ঝাঁপ দিই। ইচ্ছে করে আম্মু একটু চুলে বিলি কেটে দিক। ইচ্ছে করে আদুরে কণ্ঠে জানতে চাক আমি আজ কি খাবো? কি রান্না করবে? সবচেয়ে বেশি মিস করি শরীর খারাপ লাগলে। অসুস্থতার রাতগুলোতে ইচ্ছে করে আম্মু পাশে থাকুক।"
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্থী। চোখেমুখে নেমে এল অন্ধকার।
অর্থীর কথাগুলো শুনে সবাই খুব মন খারাপ করল। ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে অর্থীই সবচেয়ে প্রাণচঞ্চল একটা মেয়ে। অথচ ওর মধ্যেও কত বিষন্নতা আছে বাইরে থেকে না বললে বোঝার উপায় নেই।
বন্ধুদের মন খারাপ করে থাকতে দেখে অর্থী বলল, "তোরা চেহারা এমন করে আছিস কেন? আরে চিল করতো। আমার কথা শুনে কষ্ট পাস না। আমার এসব অভ্যাস হয়ে গেছে। "
"কি ব্যাপার পঞ্চপান্ডব, তোরা এখানে? আমি তোদেরকে কোথায় কোথায় না খুঁজলাম।" হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রুপম বলল কথাগুলো।
এত কষ্ট করে খোঁজাখুঁজি না করে যে কাউকে একটা কল দিলেইতো হয়ে যেত। তোর মাথায় দেখি একটা গাধার বুদ্ধি ও নেই। ভ্রু কুঁচকে বলল অর্থী।
"আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই রে। আমাকে বাদ দিয়ে তোরা চকলেট পার্টি চালাচ্ছিস। আজব!"
কপট অভিমান দেখালো রুপম।
অর্থী এগিয়ে এসে ওর ভাগের চকলেটগুলো হাতে দিতে দিতে বলল, "এখান থেকে দুটোর বেশি খাবি না। বাকিগুলো সব ঝুমুরের জন্য।"
রুপমের মন নরম হল অর্থীর প্রতি। রুপমের ছোট বোন ঝুমুর। ক্লাস সিক্সে পড়ে। এই বোনটা রুপমের বড্ড আদরের। অর্থী প্রায়ই রুপমের হাত দিয়ে আদর করে এটা সেটা পাঠায় ঝুমুরের জন্য। রুপমের বাবা নেই। রুপমের বাবা যখন মারা গেলেন তখন রুপম এস এস সি পরীক্ষার্থী।
সেদিন ছিল রুপমের ম্যাথ এক্সাম। এক্সাম হলেই পিয়নের হাত দিয়ে একটা স্লিপ এল। হলের দায়িত্বরত শিক্ষক স্লিপটা পড়ে নিয়ে একবার পুরো ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, "শাহেদ বিন আজাদ কে? "
অবাক রুপম দাঁড়ালে তিনি আবার জানতে চাইলেন, "তোমার লেখা শেষ? "
"প্রায় শেষ স্যার। আর ২০ নম্বরের আন্সার করা বাকি।" রুপম বলল।
"ঠিকাছে। শেষ কর। শেষ করে দুবার রিভিশন দিয়ে একটু আমার কাছে আসবে।" কথাটা বলেই তিনি পুণরায় নিজের কাজে মন দিলেন।
রুপম কিছু না বুঝলেও স্যারের কথামতো লেখা শেষ করে দুবার রিভিশন দিয়ে নিল। তারপর উঠে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শিক্ষক ভদ্রলোকের কঠিন চেহারাটা হঠাৎ ই নরম হয়ে উঠলো। বললেন," এক্সাম কেমন দিলে? "
"ভালো দিয়েছি স্যার।" বলল রুপম।
"শোন। জীবনটা খুব সহজ নয়। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমাদের চলতে হয়। সুতরাং প্রতিটা দু:খ কষ্ট আমাদের জীবনেরই অংশ। সেগুলো সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে হয়। "
রুপম কিছুই বুঝতে পারছেনা। এতগুলো ছাত্রের মধ্য থেকে ওকে আলাদা করে ডেকে এসব বলার মানে কি? জিজ্ঞাসু চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল রুপম।
খুব ধীরে নরম স্বরে ভদ্রলোক বললেন, "তোমার বাবা মারা গেছেন। একটু আগে সেই নিউজটাই এসেছে। আমাকে ভুল বুঝো না। যিনি চলে গেছেন তিনি আর ফিরবেন না। কিন্তু লেখার মাঝখানে এরকম একটা নিউজ তোমার ফিউচারে বাজে প্রভাব ফেলত। আ'ম স্যরি। খাতাটা জমা দিয়ে দ্রুত চলে যাও। "
সেদিনের সেই দায়িত্বরত শিক্ষকের প্রতি রুপম আজো মনেমনে কৃতজ্ঞতাবোধ করে। রুপমের বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। সুতরাং মাসের শেষের একটা পেনশনের টাকা মায়ের হাতে আসে বটে কিন্তু বর্তমান সময়ে একটা সংসার চালানোর জন্য সেটা কিছুই না। রুপম টিউশন পড়ায়। নিজের খরচটা নিজেই ম্যানেজ করে নিয়ে মাকেও হেল্প করে যতোটা পারা যায়। ছোটখাটো বাড়িটা তাদের নিজস্ব বলেই অন্তত বাড়িভাড়ার প্রেশারটা নেই। পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পাওয়াটাই এখন ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
রুপম নিজের দু:খ দূর্দশা নিয়ে কখনো বন্ধুদের সামনে হা হুতাশ করে না কিন্তু ওর জীবনের এই গল্পগুলো সবাই জানে। এই বন্ধু বৃত্তের প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটা বন্ধুর জীবনের ভালো খারাপ সব অধ্যায় সম্পর্কে জানে। ওরা একে অপরের হাতে হাত রেখে পরষ্পরকে ভরসা দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে মনেমনে।
----------------------
চার পাঁচদিন ধরেই প্রাঙ্গণকে একবার ও দেখা যায়নি ভার্সিটিতে। একটা দূরত্ব রেখা টানলেও অর্থী ঠিকই তার নিজের মত করে প্রাঙ্গণকে লক্ষ্য করে। সেটা শুধু প্রাঙ্গণকে বুঝতে দেয় না। না চাইতেও ভেতরে ভেতরে কিছুটা অস্থিরবোধ করল অর্থী। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ওর দুজন বান্ধবী আছে বটে। তবে হুট করে এভাবে ওদের কাছে জানতে চাওয়াটা একদমই ভালো দেখায় না। তাছাড়া, ওর আর প্রাঙ্গণের ব্যাপারটা মুখে মুখে ছড়িয়ে অনেকের কানেই গেছে। তাই এই ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলেই সেটা হবে আগুনে ঘি ঢালার মত ব্যাপার। প্রথমবারের ভুল সে আর করবে না। এখন একমাত্র ভরসা হল রুপম। ওকে বললেই দুই মিনিটের মাথায় খবর যোগাড় হয়ে যাবে। শুধু প্রব্লেম হল প্রচুর ক্ষেপাবে এটা নিয়ে ফাজিলটা। তারপর ও রুপমই সেইফ সবচেয়ে।
"রুপম, আমার একটা কাজ করে দিবি?"
অর্থীর কণ্ঠে নরম সুর শুনে রুপম ভ্রু কুঁচকালো। এই মেয়ে কখনোই এত মিষ্টি করে কথা বলে না সহজে৷
"কি রে? আমারে দিয়ে কোন আকাম করানোর ধান্দা করবি না। খবরদার!" চোক পাকিয়ে বলল রুপম।
"ভাই প্লিজ একটা ছোট্ট কাজ করে দে। প্লিজ!"
রুপম অবাক হলো না। কোন কাজ করিয়ে নিতে হলে অর্থী এতোটাই নরম হয়েই অর্ডার দেয়। আপাতদৃষ্টিতে এটা অনুরোধ শোনালেও এটা মূলত অর্ডার।
ফোস করে নি:শ্বাস ফেলল। রুপম।
"বল। কি করতে হবে?"
একটু ইতস্তত করে অর্থী বলল, "৪/৫ দিন ধরে আশফাক স্যারকে দেখা যাচ্ছে না। "
এইবার রুপম চূড়ান্ত অবাক। ও ভেবেছিল সেদিনের পর থেকে প্রাঙ্গণের ভূত ওর মাথা থেকে বিদায় নিয়েছে।
রুপমকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্থী ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, "ভ্যাবলার মত হা করে আছিস কেন? নিউজটা আমার আধাঘন্টার মধ্যে চাই। "
এইবার অর্থী তার নিজের আসল রুপে ফেরত এসেছে। রুপম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল," স্যার অসুস্থ।।"
"তুই কিভাবে জানলি? "
"কার কাছে যেন শুনলাম। এখানেই নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। পরে উনাকে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। হাসপাতালে এডমিট করানো হয়েছিল শুনেছিলাম।"
"তুই এত তথ্য জানিস আমারে একবার ও জানালি না ব্যাপার কী?" থমথমে মুখে বলল অর্থী।
"তুই যে স্যারের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী সেটা আমি কিভাবে জানবো। আমিতো ভেবেছিলাম তুই স্যারের নাম শুনলে ক্ষেপে যাবি। তাই আর বলিনাই। "
"ফোস করে শ্বাস ফেলে বিষন্ন কণ্ঠে অর্থী বলল, কথায় কথায় হইলেও বলতি। "
"এখন তো জানলি। এখন করবিটা কী?"
"স্যারকে একটু দেখতে যাবো। তুই যাবি আমার সাথে। "
----------
হাসপাতালের কেবিনে প্রাঙ্গণের সামনে বসে আছে রুপম। অর্থী জোর করে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাঙ্গণের অসুস্থতার কিথা শুনে যে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল সে উৎসাহে আবার ভাটাও পড়েছে। লজ্জা, অস্বস্তি সবকিছু একসাথে এটাক করেছে। সামনে যেতে আর পা এগুচ্ছে না। রুপমকে জোর জবরদস্তি করে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাঙ্গণ বেশ অবাক হয়েছে রুপমকে দেখে। ওকে এভাবে এখানে দেখবে ভাবতে পারেনি।
প্রাঙ্গণের এই অবাক করা চাহনি রুপমকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সেটা বুঝতে পেরে প্রাঙ্গণ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।
:বোসো। তোমার নাম কী?
:শাহেদ বিন আজাদ।
:আমাকে দেখতে এসেছ?
:জি স্যার।
:আমার অসুস্থতার কথা জানলে কিভাবে?
:স্যার, আপনি যে সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সেটা মোটামুটি পুরো ভার্সিটিতে সবাই জেনে গেছে। স্যার, আপনার কি হয়েছে?
:টাইফয়েড।
:ও। এখন কেমন লাগছে? হাসপাতালে আর কতদিন থাকতে হবে?
:এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। জ্বরটা আসে নিয়ম করে। তুমি কি একা এসেছ?
প্রাঙ্গণের এই প্রশ্নে রুপম একটু চমকে কেবিনের দরোজার দিকে তাকালো। প্রাঙ্গণ ভ্রু কুঁচকালো। রুপমকে ও চেনে। অর্থীর সাথে বহুবার দেখেছে। রুপমের এখানে আসার পেছনে অর্থীর কোন যোগ আছে বলে ও মনে মনে ধরে নিয়েছে। মেয়েটা তাহলে সিক্রেটলি ওর খোঁজ খবর রাখছে।
কেবিনের বাইরে থেকে অর্থী ওদের কথোপকথন পুরোটা শুনতে পাচ্ছে। মনেমনে ভয় পাচ্ছে রুপম গাধাটা আবার ওর কথা বলে না দেয়।
এদিকে রুপম নার্ভাস হয়ে বারবার দরোজার দিকে তাকাচ্ছে দেখে প্রাঙ্গণের মনে ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিল। রুপমের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলল ওকে। তারপর বেড থেকে নেমে ধীরে ধীরে দরোজার দিকে এগুলো। আস্তে করে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল।
অর্থী দাঁড়িয়ে ছিল দেয়ালে হেলান দিয়ে। দরোজার খোলার শব্দে মুখ ঘোরাতেই চোখের সামনে দেখতে পেল প্রাঙ্গণের উঁকি দেয়া মুখ।
গম্ভীর কণ্ঠে প্রাঙ্গণ বলল, "ভেতরে এসো।" বলেই ভেতরে ঢুকে গেল। অর্থী জমে বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
.........