Type Here to Get Search Results !

দ্বিধা (শেষ পর্ব_৭ )


 শম্পার প্রেগ্ন্যাসির এখন ছয় মাস চলছে। শারীরিক পরিবর্তন চোখে পড়তে শুরু করেছে। আদনানের যত্ন, পরিবারের ভালোবাসা, কলিগদের সহযোগিতা সব মিলিয়ে মা হওয়ার এই জার্নিটা খুব একটা খারাপ কাটছে না। প্রতিদিন আদনান অফিস যাবার পথে শম্পাকে ওর অফিসে নামিয়ে দিয়ে যায় ফেরার পথে আবার সাথে নিয়ে আসে।

এরমধ্যে একদিন শরীফুল আশরাফ চৌধুরী আদনানের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। বাবা ছেলে দুজনেই সাইলেন্ট মুডে বসেছিল অনেক্ষণ। পরে শম্পা এসে দুজনের মধ্যাকার নীরবতা ভঙ্গ করে ওদেরকে সহজ হতে সাহায্য করল। শরীফুল আশরাফ শম্পার কাছে ক্ষমা চাইলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল। তবে আদনান ওর ফ্ল্যাট ছেড়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাজি হলো না। পরে শম্পার অনেক বোঝানোর ফলে ডেলিভারির পর একবারে বেবিকে নিয়েই উঠবে বলে শম্পাকে আস্বস্ত করল। আসমা জাহান এই সুখবরটা স্বামীকে জানালে তিনি দেখেছিলেন এই অহংকারী আর কঠিন ব্যাক্তিত্বের মানুষটির চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। প্রজন্মের কাছে মানুষ সবসময় ভীষণ দূর্বল।
------------
রাফিদ আর রুম্পার সম্পর্কটা অনেকটাই এগিয়েছে। রূম্পা রাফিদের সাথে এখন অনেকটাই সহজ। রাফিদের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার ক্লান্তিকে ভুলতে ভিডিও কলে রুম্পাকে তার এক ঝলক দেখা চাই। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা মুহুর্তের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সবকিছু ম্যাসেঞ্জার বা হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটে একে অপরের কাছে তুলে ধরে দিনশেষে। যোজন যোজন দূরত্বে থেকেও যেন একে অপরের প্রতিদিনের জীবন ধারণকে দেখতে পায়, উপলব্ধি করে।
--------------
রিমি এখন একটা চাকরি করে। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করার ইচ্ছে থাকলেও সেই ইচ্ছের কথা মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করেনি কাউকেই। তন্ময় মাঝেমাঝে বলত ইচ্ছে হলে জব ট্রাই করতে। ঘরে বসে থাকলে এত এত পড়াশুনা কোন কাজেই লাগবে না। তবুও রিমির বাধ বাধ ঠেকত। কিন্তু একদিন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত শাশুড়ি মা রিমিকে বললেন বসে না থেকে একটা কিছু করতে। তিনি হয়ত রিমির মনের ইচ্ছেটা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বউ শাশুড়ির চা খেতে খেতে গল্প চলছিল। তখনই রেহানা পারভীন কথা তুলেছিলেন।
"বউ মা, তোমার চাকরি করার কোন ইচ্ছে নেই?"
রিমি বেশ চমকে উঠেছিল। সেইসাথে কি উত্তর দেবে ভাবতে ভাবতেই রেহানা পারভীন আবার বললেন," তোমার ইচ্ছে থাকলে তুমি চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারো। লেখাপড়া জানা একটা মেয়ে এভাবে ঘরে বসে থাকবে? এত পড়াশুনা করলে সেগুলো কোন কাজে লাগাবে না? "
শাশুড়ির কথায় রিমির মনটা মুহুর্তেই ভালো লাগায় ভরে গেল। তবু বলল," আমি চাকরি করলে আপনার কোন আপত্তি নেই মা? "
"আপত্তি থাকলেত এইকথা তুলতাম না। একটা মেয়ের জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা ভীষণ জরুরি। তারচেয়ে ও বড় কথা হল নিজের একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করা যায়। আমার পরিবারের এক দু:সময়ে আমার মেয়ের চাকরিই কিন্তু আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। নিজের মেয়ের চাকরির ব্যাপারে যেহেতু আপত্তি ছিলনা তোমার বেলায় কেন আপত্তি করব? তুমি চাইলেই চাকরির জন্য এপ্লাই করতে পারো। চাকরি পেলে করো, ভালো না লাগলে ছেড়ে দিও। দুটো পথই তোমার জন্য উন্মুক্ত।"
সেদিন রিমি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা স্বরুপ শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসেছিল কিছুক্ষণ। তারপর তন্ময় এলে ওর সাথে ব্যাপারটা আলাপ করল। তন্ময়ের ঠোঁটের কোণে দেখা গিয়েছিল গৌরবের হাসি। তন্ময় জানতো মা কখনোই আপত্তি করবেন না এই ব্যাপারে।
দু মাস হতে চলল রিমি চাকরি করছে। শাশুড়ির সহযোগিতায় ঘর সামলাচ্ছে বাইরে নিজের যোগ্যতায় নিজের কাজ সামলাচ্ছে। তন্ময় আর রিমি রোজ একসাথে বেরোয়, ফেরার সময় রিমি আগে ফেরে। ফ্রেশ হতে হতেই দেখে শাশুড়ি চা নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেখে দেয়। তন্ময় ফিরলে একসাথে চা খায়। সারাদিনের গল্প করে। দিনশেষে যখন ক্লান্তি ঘুচাতে একে অপরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন মনে হয় জীবনটা সুন্দর। নিজের মতো করে কাটাতে জানলে জীবনটা অনেক সুন্দর।
-----------------
অরুপ এখন সপ্তাহে দুদিন বা তিনদিন মিথিলার ইউনিভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এত ব্যস্ততার মাঝেও এইটুকু সময় সে ঠিকই বের করে নেয়। উদ্দেশ্য মিথিলাকে এক নজর দেখা আর কথা বলার জন্য সুযোগ খোঁজা। মিথিলা একবার ফিরেও তাকায় না। অরুপের সামনে দিয়েই হেঁটে গিয়ে রিক্সায় উঠে চলে যায়। তারপর অরুপ অফিসে চলে যায় আর মিথিলা বাসায়। অরুপকে এভাবে দেখতে ইদানীং ওর বেশ খারাপ লাগছে। আগের চেয়ে মন নরম হয়েছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। সত্যি বলতে অরুপকে এক নজর দেখতে পেলে ওর নিজের ভেতরটাও প্রশান্তিতে ভরে যায়। তবুও এত সহজে ক্ষমা করবে না। প্রয়োজনে ক্ষমা করবেই না। বাবার পছন্দ করা কোন ছেলেকেই টুপ করে বিয়ে করে নেবে। মনে মনে এই কথা ভেবে নিজেই ব্যথিত হয়। নিজেকে অন্য কারো সাথে কল্পনা করতেই বুকে ব্যথা জাগে। কি জানি,,, একদিন হয়ত টুপ করে অরুপকেও ক্ষমা করে দেবে। এইসব ভাবলে মিথিলার নিজেরই মাথা আওলা ঝাওলা লাগে। এখন সব বাদ। সামনেই ফাইনাল এক্সাম। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। যেকরেই হোক।
ভাবনার জাল ছিড়লো ফোনের রিং এর আওয়াজে। আননোন নাম্বার দেখেই বুঝল আরুপ ছাড়া এই সময় আর কেউ ফোন দেবে না। কি ভেবে যেন মিথিলা ফোন রিসিভ করল।
"হ্যালো। "
হতভম্ব অরুপ ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফোনের দিকেই তাকিয়ে রইল।
-----------
অফিস রুমের জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে প্রাঙ্গণ। প্রায় প্রতিদিনই এই সময় নিয়ম করেই অর্থীরা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আড্ডা দেয়। জায়গাটা অফিস রুমের জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। প্রাঙ্গণ দেখতে থাকে হাত নেড়ে নেড়ে অনর্গল কথা বলতে থাকা অর্থীকে। মেয়েটাকে দেখলেই কেন যেন মনে প্রশান্তি আসে।
সেদিন হাসপাতালে অর্থী ধরা পড়ে যাবার পর অপরাধীর মত কেবিনে ঢুকেছিল। প্রাঙ্গণের মা ও ঠিক একই সময় এসে কেবিনে ঢুকেছিলেন। প্রাঙ্গণ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই স্টুডেন্টদের সাথে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। অর্থীর সাথে টুকটাক গল্পও করলেন তিনি। তারপর এক ফাঁকে ডাক্তারে সাথে দেখা করবেন বলে বেরিয়ে গেলেন।
অর্থী আর রুপম কাঠ কাঠ হয়ে বসে রইল। তিনজনেই চুপচাপ। প্রাঙ্গণ অর্থীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। বাচ্চা একটা মেয়ে। আসলেই কি ওকে ভালোবাসে নাকি পুরোটাই আবেগ? অবশ্য প্রাপ্তবয়স্ক হলেই যে তার ভালোবাসায় গভীরতা থাকবে এটা যে সত্যি নয় সেটা নিয়ে প্রাঙ্গণের খুব খারাপ একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতি রুপমের বড্ড দমবন্ধ লাগছে৷ সেই সাথে অর্থীকে স্যারের সাথে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই রুপম একটু আসছি বলে ফোনে ব্যস্ততা দেখিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
এবার প্রাঙ্গণ একটু নড়েচড়ে বসল।
"এভাবে কাঠ কাঠ হয়ে আছো কেন? আমাকে দেখতে এসেছ বললে কই একবারও তো আমার দিকে তাকাতে দেখলাম না। না তাকালে দেখবে কিভাবে? "
আশফাক স্যারের এরকম কথাবার্তা শুনে অর্থী চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়ল। আমতা আমতা করে শুধু বলেছিল, "আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি, স্যার। "
এইকথা শুনে হঠাৎ প্রাঙ্গণ হো হো করে হেসে উঠেছিল।
সেদিনের পর অর্থী আবারো আগের মতোই চলাফেরা করতে লাগলো৷ না প্রাঙ্গণের সামনে আসে না কথা বলার চেষ্টা করে। তবে গোপনে ঠিকই খোঁজ খবর রাখে, আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখে। ও শুধু জানে না এই কাজটা এখন অপর পক্ষ থেকে প্রাঙ্গণ ও করে।
---------
ধরনীর বুকে হাজার বছর ধরে জ্বলতে থাকা সেই পুরোনো সূর্যটাই প্রতিদিন নতুন নতুন আলো ছড়িয়ে যায়। কারো জীবন পুরোনো কোন কিছুর জন্য আটকে থাকে না, থেমে থাকে না।
প্রতিটা দিন মানুষের জীবনে নতুন ভোর নিয়ে উপস্থিত হয়। সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে মানুষ চাইলেই জীবনের রংচটা অতীতগুলোকে ঝেড়ে ফেলে শুরু থেকে আবার শুরু করতে পারে।
যেমনটা শুরু করেছে শম্পা তার অতীত ভুলে, যেমনটা শুরু করেছে রূম্পা তার নিজেকে পরিবর্তন করে, যেমনটা শুরু করতে চাইছে অরুপ তার মিথিকে নিয়ে, যেমনটা শুরু করবে বলে ভাবছে প্রাঙ্গণ হয়ত সেটা অর্থীকে নিয়েই।
বহতা নদীর মত জীবন বয়ে চলে তার গন্তব্যের দিকে। পিছু ফিরে তাকাবার কোন দায় থাকে না।
[ সমাপ্ত ]

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.