৯.
এনগেইজমেন্টের প্রস্তুতি চলছে ঘরে। কেমন একটা সাজসাজ রব সারা বাড়িতে। কিন্তু যার জন্যে আয়োজন তার মনে কোন আনন্দ নেই।
শূন্য দৃষ্টি নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে রিমি।। এমন সময় ফোনে রিং বেজে উঠল।
স্ক্রিনে তন্ময়ের নামটা দেখে প্রথমে বিশ্বাস হতে মন চাচ্ছিল না। কয়েক সেকেন্ড পরই কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করল রিমি।
"কেমন আছো?"
তন্ময়ের কণ্ঠস্বরটা যেন রিমির কলিজায় গিয়ে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
"আমার সাথে কথা বলবে না?"
এবার আর চুপ থাকতে পারলো না রিমি। কান্না পেয়ে গেল। সেই কান্না চেপে রাখতে গিয়ে কণ্ঠস্বর আরো রুদ্ধ হয়ে গেল।
রিমি কাঁদছে বুঝতে পেরে তন্ময় নিজেই চুপ করে রইল। কষ্টে বুক ভেঙ্গে গেলেও ও চাইছে রিমি একটু কাঁদুক। কেঁদে হালকা হোক। এই কটাদিন মেয়েটাও ভীষণ চাপ সহ্য করেছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে তন্ময় যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়াতে। তন্ময় বুঝতে পারে সেটা।
বেশ অনেকটা সময় চুপ থাকার পর তন্ময় আবার কথা বলে।
"রিমি, একটু বের হতে পারবে বাসা থেকে? আজ অথবা কাল? আজ হলে বেশি ভালো হয়। "
রিমি একটু চিন্তা করল তারপর বলল, "আজকে পারবো না। আগামীকাল। কোথায় আসবো?"
"কলেজ গেইটের সামনে চলে এসো। ওখান থেকেই কোথাও একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসব না হয়। " বলল তন্ময়।
রিমি ছোট্ট করে জবাব দিল 'ঠিকাছে।'
"একটু ভিডিও কলে আসবে? তোমাকে একটু দেখবো। প্লিজ!" তন্ময় অনুরোধ জানালো।
মনেমনে অনেক অভিমান জমলেও রিমি জানে তন্ময় ওকে কতোটা ভালোবাসে। তাই ওর করুণ কণ্ঠের আকুতিমাখা অনুরোধের উপর সরাসরি না বলতে পারলো না।
ডাটা অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপে কল এল। রিমি ফোন রিসিভ করল।
ফোন রিসিভ করেই দুজন দুজনকে দেখে ভীষণভাবে চমকে উঠলো। একপ্রান্তে মলিন, বিষন্ন মুখে তাকিয়ে আছে রিমি, অপর প্রান্তে বিধ্বস্ত চেহারা আর অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তন্ময়। কতোদিন পর একে অপরকে দেখলো।
তন্ময় চুপচাপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিমির দিকে। আর রিমি নীরবে অশ্রু ঝরিয়েই যাচ্ছে আর বারবার চোখ মুছছে। তীব্র কষ্টে তন্ময়ের হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থেকে চট করে ফোন ডিস্কানেক্ট করে দিল।
রিমির এই কান্না সহ্য করা ওর পক্ষে ভীষণ কঠিন। অথৈ সমুদ্রে প্রচন্ড ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া কোন জাহাজের কাপ্তানের মত ও কোন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না।
....
:আমরা কি আজকে নিউ আন্টির সাথে দেখা করতে যাবো, বাবা?
:হ্যাঁ, মামনি।
:কখন যাবো?
:এইতো বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়বো আমরা।
:আন্টি কী আমার জন্য চকলেট আনবে?
:আমিতো জানি না মা। আনতেও পারে।
:বিকেল হতে আর কত দেরী, বাবা?
মেয়ের অস্থিরতা দেখে হেসে ফেলল আমজাদ। বলল, "এইতো একটু পর টুপ করে বিকেল হয়ে যাবে। কিন্তু তোমারতো এখনো কত কাজ বাকি। গোসল করবে, লাঞ্চ করবে। এত বকবক করলে এইসব কাজ করবে কখন?
এখন যাও নীলু আন্টির সাথে গিয়ে গোসল সেরে নাও। আমি আর দাদুভাই নামাজ পড়ে এসেই একসাথে খেতে বসব।"
ঠিকাছে বলেই এক ছুটে চলে যায় তুতুল।
আমজাদ মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নেয়া সিদ্ধান্তটা সঠিক নাকি ভুল সেটা নিয়ে কিছুটা সংশয় এখনো মনের কোণে রয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো এবং পা বাড়ালো মসজিদের উদ্দেশ্যে।
...
অনেকদিন পর আজ শম্পা একটু সাজলো। হালকা গোলাপি জমিনের সাথে সাদা পাড়ের একটা মনিপুরী শাড়ি পড়ল। এই শাড়ি পোশাকটার প্রতি শম্পার বেশ দূর্বলতা আছে। সময় সুযোগ পেলেই ও শাড়ি পরে এবং সে খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে শাড়ি পরতে জানে।
শাড়ির সাথে ম্যাচ করে একটা পার্লের মালা আর কানে একজোড়া পার্লের টপ পরলো। চোখে একটু কাজল টেনে নিয়ে ঠোঁটে হালকা শেডের একটু লিপস্টিক ছোঁয়ালো। এইটুকুতেই ওকে ভীষণ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।
একসময় ও সাজতে খুব পছন্দ করত। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক দিত আর চোখ ভরে কাজল, আই লাইনার, মাশকারা কিছুই বাদ যেত না। কখনো কখনো বেড়াতে গেলে বা কোন অনুষ্ঠানে গেলে ভারী মেকাপ ও নিত। কিন্তু এখন আর সেসব কিছুই করে না। টিকে থাকার সংগ্রাম করতে করতে জীবনের অনেক রঙ হারিয়ে ফেলেছে। মুছে গেছে কত শখ, কত আহ্লাদ। সময় এবং পরিস্থিতি কতকিছু যে কেড়ে নিয়েছে ওর কাছ থেকে তার হিসেব নেই।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে একটু দেখে নিল। নাহ্! খারাপ লাগছে না।
শম্পাকে সাজতে দেখলে একসময় আদনান খুব রাগ করত। কতবার জোড় করে টিস্যু দিয়ে ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দিয়েছে। প্রায়ই ওকে ক্ষেপিয়ে বলত ময়দা মাখা সুন্দরী। আর বলত, "আটা ময়দা মেখে এত মায়া মায়া মুখটার কী অবস্থা করেছিস রে? তোকে সুন্দর দেখাতে তোর চোখ দুটোই যথেষ্ট। এত সাজাসাজি করবিনাতো। ভাল্লাগে না। "
বলেই টিস্যু দিয়ে ওর লিপস্টিক মুছে দিত।
কথাটা মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল। ফোনে এক পলক টাইম দেখে নিয়ে পার্সটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়েই দেখল তন্ময় ও বেরোচ্ছে। দুজনেই মুখোমুখি হয়ে গেল।
"কি রে, কোথাও যাচ্ছিস?" বলল শম্পা।
"হ্যাঁ আপু। একটু বেরোবো। তুমি কী আমজাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছো?" জানতে চাইলো তন্ময়।
তন্ময় এভাবে জিজ্ঞেস করাতে শম্পা একটু লজ্জা পেল। যেন কোন তরুণী তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যাবার বেলায় ধরা পড়ে গেছে। মনেমনে লজ্জা পেলেও সেটা তন্ময়কে বুঝতে দিল না। বলল, "হ্যাঁ৷ আজকে উনার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনার বাচ্চাটাও আসবে সাথে। তুই কোথায় যাচ্ছিস?"
তন্ময় চট করে জবাব দিতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, "কলেজ গেইটে যাবো। এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি৷"
"চল তাহলে একসাথে বের হই৷ আমি শিশু পার্ক যাবো। তোকে নামিয়ে দিতে পারবো। "বলল শম্পা।
মাকে ডেকে দরোজা বন্ধ করতে বলে দুজনেই বেরুলো একসাথে।
-------------
১০.
বশিরুল্লাহর সামনে বসে আছে আদনান। চাইলেও তিনি আদনানের উপর বিরক্ত হতে পারছেন না। এই ভাগ্নে একসময় অনেক আদরের ছিল। বহুদিন যোগাযোগ না থাকলেও ভেতরের স্নেহটা একেবারেই মরে যায়নি সেটা বুঝতে পারলেন উনি। ছেলেটাকে দেখে বরং মায়াই হচ্ছে এক রকম।
"মামা, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে? " বলেই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদনান।
বশিরুল্লাহ নড়েচড়ে বসলেন। আদনান কেমন একটা দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উনার দিকে। তিনি অত্যন্ত অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন।
"তুই অনেক দেরী করে ফেলেছিস আদনান। শমুকে এই এক জীবনের শুরুতে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। যে সময়টাতে তোকে ওর পাশে দরকার ছিল সেসময়টাতে তুই ওর পাশে ছিলিনা বা থাকতে পারিসনি যাই বল না কেন কিন্তু এভাবে এত বছর পর হুট করে ফিরে এসে এরকম একটা ডিসিশন নিতে চাইছিস ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলনা?
আমিই বা কোন মুখে শমুকে ব্যাপারটা বলবো বলত যেখানে ওর এই বিয়েটা আমি নিজেই ঠিক করেছি।" বলেই থামলেন বশিরুল্লাহ।
"মামা, তুমি আমার দিকটাও বোঝার চেষ্টা করো। আব্বু আম্মু আমাকে যখন জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল তখন কি আমার নিজে থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার মত সিচুয়েশন ছিল? আমি তখন স্টুডেন্ট। আমার নিজেরইতো কোন ভিত ছিল না। আব্বুর কড়া শাসনে বড় হয়েছি। উনার সব কথা বাধ্য হয়ে শুনতে হতো। শমুর পাশে দাঁড়াতে গেলে মিনিমাম যে যোগ্যতাটুকু লাগে সেটুকুও ছিলনা আমার। তখন আমার কিছুই করার ছিলনা।" বলল আদনান।
"তুইতো ফিরে এসেছিলি। তখন শমুর সাথে যোগাযোগ করিসনি কেন?" বললেন বশিরুল্লাহ।
"মামা, সেদিনকার ঘটনাটা তুমি জানো যে কি হয়েছিল। জেনে শুনেও এভাবে বলবে? যেদিন দেশে এলাম এক রকম ছল চাতুরী করেই আমার আক্দ পড়িয়ে দেয়া হল। এরপর কোন মুখে আমি শমুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম বলো? ওকে গিয়ে কি বলতাম? বলতাম যে শমু আমি ফিরে এসেছি এসেই বিয়ে করে ফেলেছি? এভাবে বলা যায়? তাইতো চুপচাপ পালিয়ে গেলাম। কিন্তু পালিয়ে আর শান্তি পেলাম কই? এমন নয় যে আমি চেষ্টা করিনি। আমি চেষ্টা করেছি আমার ভাগ্যকে মেনে নিতে। কিন্তু সবকিছুর মাঝেও কিছু নেই এই বোধটা আমাকে একদম স্বস্তি দিতো না৷ তার উপর আমার স্ত্রী রেহনুমা। ওকে যতবার নাম ধরে ডাকি আমার সামনে শমুর চেহারাটা ভাসতে থাকে। কি এক দূর্বিষহ যন্ত্রণায় আমার দিনগুলো কেটেছে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। "
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলেই দুই হাতে মুখ ঢাকলো আদনান।
"তোর স্ত্রীরতো এক্ষেত্রে কোন দোষ নেই। ডিভোর্স দিয়ে এভাবে মেয়েটার ক্ষতি করলি কেন?" বললেন বশিরুল্লাহ।
"ভুল ভাবছো তোমরা। আমি ওর কোন ক্ষতি করিনি। ইনফ্যাক্ট, ডিভোর্সটা ওর পূর্ণ সম্মতিতে হয়েছে। আভ্যন্তরীণ কিছু ব্যাপার আছে যেটা কাউকে বলতে পারছি না।
বিয়ের পর প্রথম রাতেই আমি ওকে শমুর কথা বলেছিলাম। তখন আমার মনের অবস্থা এতই খারাপ ছিল হুট করে অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। আমি সময় চেয়েছিলাম কিছুদিন।।
শুরুতে মেয়েটা মেনেও নিল। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ভেবে একসময় আমিও সবকিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করার কথা ভাবলাম। ভাবতাম এই মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু, ওইদেশে যাবার পর রেহনুমার আচরণ ধীরে ধীরে পালটে যেতে লাগলো। একসময় এমন অবস্থা হল ও পান থেকে চুন খসলে আমাকে আর শমুকে জড়িয়ে নানারকম আজেবাজে কথা বলতে শুরু করল। সবকিছু সহ্য করা গেলেও শমুকে নিয়ে বলা নোংরা কথাগুলো আমার বুকে গিয়ে বিঁধত। রেগে গিয়ে একদিন আমি ওর গায়ে হাত ও তুলেছিলাম। ও হয়ত এটাই চাইছিল। ডিভোর্সটা ওই চেয়েছিল। তোমারা কেউ জানো না কিন্তু আমার আর রেহনুমার ডিভোর্সটা কিন্তু আরো এক বছর আগেই হয়েছে। এদিকে কাউকে জানতে দিইনি আমরা। এই একটা বছর আমি নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। আমিওতো একটা মানুষ, মামা। "
বশিরুল্লাহ কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তবে সামনে বসে থাকা ভাগ্নের জন্যেও উনার ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো। কিন্তু এই মুহুর্তে আদনানকে সাহায্য করার মত কোন উপায় উনি নিজে দেখতে পাচ্ছেন না। একটা পথ উনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। সেটা কিভাবে খুলবেন উনার জানা নেই। ধীরে ধীরে উঠে এসে তিনি আদনানের মাথায় হাত রাখলেন। এক উভয়সংকটে পড়ে নিরুপায় হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
-----
দীর্ঘসময় ধরে চুপচাপ বসে আছে তন্ময় আর রিমি। দুজনের কেউই কোন কথা বলছেনা। তন্ময় রিমিকে খুব মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে। এই কদিনে মেয়েটা শুকিয়ে গেছে অনেকটা। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল, রুক্ষ চুল, মলিন চেহারা। তন্ময়ের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো।
তন্ময় রিমির হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিল।। বলল,
"আ'ম স্যরি রিমি। এই কদিন তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। "
রিমির চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। কিছু বলছে না।
তন্ময় আবার বলল, "রিমি, আমি জানি এটা অনেকটা স্বার্থপরের মত হয়ে যাচ্ছে, তোমার এনগেইজমেন্টের ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে আর এই মুহুর্তে এসে আমি তোমাকে এইসব বলছি। তবুও একটা কথা জানাতে এলাম। এই কথাটা আর কদিন আগে হলে হয়ত একটা গুড নিউজ হিসেবে দিতে পারতাম। এখন খবরটা ভালো হলেও তুমি কিভাবে সেটা নেবে বুঝতে পারছি না। "
কথাগুলো শুনে রিমি তন্ময়ের দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো।
"আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আপু এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। কোনভাবে কী তোমার বিয়েটা আটকানো যায় রিমি? "
-----------------
১১.
"থ্যাঙ্কিউ আন্টি।" হাতে দুটো ক্যাডবেরি নিয়ে হাসিমুখে বলল তুতুল।
ছোট বাচ্চাদের সাথে খুব একটা মিশতে পারে না শম্পা। বাচ্চাদের সাইকোলজি বুঝতে কেন যেন ওর বেশ অসুবিধা হয়। তারপর ও স্বাভাবিক বুদ্ধি খাটিয়ে চকলেট দুটো এনেছিল তুতুলের জন্য। এখন মনে হচ্ছে বাচ্চা মেয়েটা পুতুল বা কোন একটা খেলনা পেলে বোধহয় বেশি খুশি হতো।
তুতুলকে নিয়ে ওরা একটা শিশুপার্কে এসেছে। আলাপ পরিচয় শেষে শিশু পার্কের সামনেই রাস্তার অপরপাশে অবস্থিত একটা রেস্টুরেন্টে বসে একটু খাওয়া দাওয়া করলো। কিছুক্ষণ গল্প করল। তারপর মেয়েটাকে শিশু পার্কে নিয়ে গেল। আন্টির সাথে গল্প করার চেয়ে রাইডে চড়ার আগ্রহে পেয়ে বসল মেয়েটাকে। তুতুলকে খেলতে দিয়ে আমজাদ আর শম্পা দুজনেই একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল।
আমজাদ যে আড়চোখে শম্পাকে একটু পরপর দেখছে সেটা শম্পা বুঝতে পারলো।
"একটা কথা জানতে চাইবো।" বলল শম্পা।
সম্মতির দৃষ্টিতে তাকালো আমজাদ।
"প্রথমদিন বলেছিলেন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার দুটো কারণ। একটা কারণতো সেদিন বললেন। দ্বিতীয় কারণটা জানতে চাই। "
হালকা কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিল আমজাদ।
"অনেকদিন আগে এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে একটা মেয়েকে আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়। মায়াকাড়া একটা মুখ আমার মনের মধ্যে একটা ঝড় তুলে দিল যেন। আর সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল চোখ দুটো কথা বলছে। আমি বেশ কয়েকবার ভাবলাম এগিয়ে গিয়ে কথা বলব। কিন্তু কোনভাবেই সাহস করতে পারছিলাম না। এরমধ্যে দেখা গেল মেয়েটা আমার এক বন্ধুর সাথে ঘোরাফেরা করছে, কথা বলছে। জানলাম মেয়েটি সেই বন্ধুর কাজিন। মনেমনে ভাবলাম বন্ধুর মাধ্যমে পরিচিত হবো বা ভালোলাগার কথা জানাবো। কিন্তু পরবর্তীতে জানলাম আমার বন্ধু নিজেই মেয়েটিকে ভালোবাসে। ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ও রয়েছে। কি আর করা, অগত্যা মনকে বোঝাতে হল।
বিয়েটা ছিল আপনার ছোট মামার। আর বুঝতেই পারছেন মেয়েটা ছিলেন আপনি। বিয়েতে আমি মেয়ে পক্ষ থেকে গিয়েছিলাম। আপনার মামী আমাদের দু:সম্পর্কের আত্মীয়া হন। দাদী বেঁচে থাকতে মোটামুটি যোগাযোগ ছিল। দাদী মারা যাবার পর যোগাযোগ কমে গেছে।"
একটানা কথাগুলো বলে আমজাদ থামলো।
শম্পার হতভম্ব ভাবটা কাটাতে সময় লাগছে।
"আপনার সেই বন্ধুটি কে?" চোখ মুখ শক্ত করে জানতে চাইলো শম্পা।
"আদনান।" ছোট্ট করে জবাব দিল আমজাদ।
"আমি আর আদনান একই কলেজে পড়তাম। বিশেষ ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও মোটামুটি চলনসই সম্পর্ক ছিল। আদনান নিজে বলে নি আমাকে তবে ওরই এক ক্লোজ ফ্রেন্ড এর মাধ্যমে আমি আপনাদের সম্পর্কের কথা জেনেছিলাম।
এরপর একদিন আপনাকে দেখলাম কলেজে। আদনানের সাথেই। এইচ এস সি তে আপনি আমাদের কলেজেই এডমিশন নিয়েছিলেন। প্রায়ই দেখতাম আপনাকে। তবে দূর থেকে। "
"বাবা, পানি খাবো।"
আলাপচারিতার মাঝখানে তুতুল ছুটে এসে জাপটে ধরলো আদনানকে।
পাশে রাখা পানির বোতলটার মুখ খুলে পানিটা খাইয়ে দিয়ে সাবধান করল আমজাদ, "খবরদার বেশি ছুটোছুটি করোনা মামনি। হঠাৎ ব্যথা পেয়ে যাবে। " মাথা নেড়ে আবার ছুট লাগায় তুতুল।
"আমজাদ সাহেব, আপনার সাথে আমার একবার পরিচয় হয়েছিল কী? সরাসরি?" জানতে চাইলো শম্পা।
আমজাদ মাথা চুলকে বলল, "হ্যাঁ। একবার কথা হয়েছিল। আদনানই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আপনার সাথে। আমি আর আদনান লাইব্রেরিতে ছিলাম। সাথে আরো কয়েজন বন্ধু সহ। আপনি আদনানকে খুঁজতে খুঁজতে লাইব্রেরিতে এলেন। আদনাদের বন্ধু সকলেই আপনাকে চিনত। সেই মুহুর্তে কেবল আমিই ছিলাম অচেনা কেউ। "
"এইজন্যেই প্রথমদিন আপনাকে আমার চেনা চেনা মনে হয়েছিল।" বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল শম্পা।
----------
রেগে আগুন হয়ে আছে রিমির বাবা আজিজুদ্দিন আহমেদ।
আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি বলে ভেবোনা যা খুশি তাই করবে। দুদিন পর এনগেইজমেন্ট আর আজকে এসে বলছ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে?
রিমি মাথা নিচু করে বসে আছে। তন্ময়ের সাথে দেখা করে এসেই মায়ের কাছে গিয়ে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার কথাটা জানালো।
দেরী না করে রিমির মা জাহানারা আহমেদ স্বামীকে এসে জানাতেই এই পরিস্থিতি।
"আমার একটা সম্মান আছে। তোমার আপত্তি থাকলে সেটা তুমি প্রথমেই জানাতে পারতে। তখন কিছু বলোনি। এখন সবকিছু ফিক্সড হয়ে যাবার পর এসে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বললেই হয়ে গেল?"
রাগে রীতিমতো কাঁপছেন আজিজুদ্দিন সাহেব।
এবার রিমি চোখ তুলে তাকালো।
"তোমরা কেউ আমার মতামত জানতে চাওনি বাবা। আমি ভেবেছিলাম একবার অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করবে। এনগেইজমেন্টের দিনটা পর্যন্ত আমাকে না জানিয়েই ফিক্সড করেছ।
এত পড়াশুনা শেখালে, এত ফ্রিডম দিলে আর জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না?"
"আমার বিশ্বাস ছিল তুমি কো অপারেট করবে। ভেবেছিলাম আমাদের সিদ্ধান্তে তুমি অমত করবে না। আমার ভুলই হয়েছে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে তাদের কাছে বাবা মায়ের মতামতের কোন মূল্য থাকে না এটা বোঝা গেল।" বললেন আজিজুদ্দিন আহমেদ।
"ভুল বলছ বাবা। সন্তান বড় হয়ে গেলে তাদেরও যে নিজস্ব একটা মত থাকে সেটাই বাবা মায়েরা মানতে চায় না। আমার উপর যেমন তোমরা বিশ্বাস রেখেছিলে সেরকম বিশ্বাস আমারও ছিল। আমিও ভেবেছিলাম আমার জীবনের এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশন নেয়ার সময় অন্তত একবার আমার মত জানতে চাইবে।" বলেই দম নিল রিমি।
ড্রইং রুমজুড়ে পিনপতন নীরবতা। মান অভিমানের ঝাঁপি উলটে দিয়ে হঠাৎ করেই যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে আজিজুদ্দিন আহমেদ চুপচাপ উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। পিছু পিছু গেলেন জাহানারা আহমেদ।
চুপচাপ মাথা নিচু করে একা বসে রইল শুধু রিমি।
-----------------
১২.
এয়ারপোর্ট এরিয়া থেকে বের হয়ে সানগ্লাসটা চোখে লাগিয়ে নিল রাফিদ। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বুক ভরে টেনে নিল জন্মভূমির বাতাসের অক্সিজেন।
চার বছর পর দেশে ফিরেছে সে। এক্ষুনি দেশে আসার কোন ইচ্ছে ছিলোনা যদিও। বিশেষ করে বাবার মুখোমুখি হওয়াটা বেশ কঠিন লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রিমির ফোন পেয়ে চলে আসতে হল। ফোনে এত কান্নাকাটি করছিল যে রাফিদের প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল।
রাফিদ রিমির ভাই। ওরা টুইন। চার বছর আগে রাফিদ পড়াশোনা করার জন্যে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। রাফিদের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে আজিজুদ্দিন আহমেদ একেবারেই রাজি ছিলেন না। বাবার সাথে একরকম বাড়াবাড়ি করেই সে চলে গিয়েছিল। সাধারণত রাফিদ শান্ত স্বভাবের হলেও সেসময় আজিজুদ্দিন আহমেদ এর সাথে রাফিদের বেশ ভালো একটা মন কষাকষি হয়েছিল। যদিও সেসব মনে পড়লে এখন খুব মন খারাপ হয় ওর।
কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে দরোজা খুলে দিলেন জাহানারা আহমেদ। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ছেলেকে দেখতে পেয়ে তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এই ফাঁকে রাফিদ টুপ করে মাকে পায়ে ধরে সালাম করে ফেলল। সম্বিত ফিরে পেতেই ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।
---
"কী ব্যাপার বলতো? আজকে তোমাকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। তুমি কি কোন কারণে আপসেট? "
কথাগুলো শুনে অন্বেষার দিকে তাকালো শম্পা।।
ঠোঁটের কোণে একটু জোরপূর্বক হাসি টেনে মাথা নেড়ে জানালো কিছু হয়নি। সব ঠিকাছে।
অন্বেষা শম্পার কলিগ। এই মেয়েটাকে শম্পা একটু এড়িয়ে চলে। মেয়েটা এমনিতেই ভালো। তবে মিশুকে বেশি। সবার সাথে মিশতে পারা ভালো। কিন্তু সে মিশতে গিয়ে অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করাটা মোটেও ভালো কিছু না।
অন্বেষার ব্যাপারটা হলো সে খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকে। সবার সাথে মিশে, কথা বলে, হেল্প করে। কিন্তু যেকোনো ব্যাপারে সে অতি উৎসাহী। কৌতুহলী হয়ে সবকিছুই জানতে চায়। অনেকটা নাক গলানোর মতো। এই ব্যাপারটা শম্পা একদমই পছন্দ করে না। এই একটা ব্যাপার বাদ দিলে মেয়েটা ভালো। আন্তরিক। শম্পা ওর চেয়ে বয়সে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও অনায়েসে তুমি বলে। আন্তরিক হয়েই বলে সেটা বোঝা যায়।
"আমার মনে হচ্ছে তুমি কোন ব্যাপারে আপসেট। শেয়ার করতে পারো। হালকা লাগবে।" বলল অন্বেষা।
"তেমন কিছু না। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই একটু শরীর খারাপ লাগছে।" বলেই মুচকি হেসে ব্যাপারটা এড়ানোর চেষ্টা করল।
তারপর ও অন্বেষা শম্পার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শম্পার উত্তরটা ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি সেটা বোঝা যাচ্ছে। শম্পাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেও নিজের কাজে মন দিল৷
রাতে সত্যিই ঘুমটা ভালো হয়নি শম্পার। অনেক বছর একভাবে জীবন যাপন করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর যখন একটা পরিবর্তন আসতে চলেছে স্বাভাবিকভাবেই একটা অজানা আশংকা ভীড় করে আছে মনে। নিজের মনকে সুস্থির করার জন্য যখন প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তখই এক সময়ে ফাগুন হাওয়া বয়ে নিয়ে আসা আদনান এবার যেন একটা ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে হাজির হল।
তবে একটা ব্যাপারতো সত্যি আদনানের পর আর কেউতো আসেনি আর ওর জীবনে। সেই সময় আর সুযোগ কোনটাই হয়নি। দায়িত্ববোধ আর সেই দায়িত্ব পালনের দিকে এতোটাই ঝুঁকে ছিল যে কে তাকে পেতে চাইছে, তার কাকে ভালো লাগছে এসব দেখার সময় একদমই হয়নি। অফিস কলিগদের মধ্যেও অনেকেই রিলেটিভ বা পরিচিতজনদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। শম্পা বেশ ভদ্রভাবে এড়িয়ে যেত।
এখন মনে হচ্ছে হাজারো অভিমান জমলেও মনের কোথাও চুপটি করে চোরকাঁটার মত আটকে আছে আদনান। বিয়েতে মত দিলেও ভেতর থেকে ঠিক শান্তিটা যেন পাচ্ছে না। তবুও এতগুলো বছর পর নিজেকে একটা সুযোগ দিতে ইচ্ছে হল ওর। নাহ্! আর কিছু ভাববে না। সময় ওর কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। অনেক হোচট খেয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে আবার উঠেও দাঁড়িয়েছে।
তার সকল অনুভূতির সাক্ষী হয়ে আছে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে কেঁদে কাটানো নির্ঘুম রাতগুলো।
---------
কেঁদে কেঁটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে রিমি। বালিশে হেলান দিয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফিদ।
"তুই আব্বুকে এখনো তন্ময় ভাইয়ের কথা বলিসই নি। মেনে নেবে কী নেবে না সেটা বুঝলি কী করে?"
রাফিদ বলল।
"তন্ময়ের কথা পরে বলা যাবে। তুই আগে আমার এনগেইজমেন্ট আটকা। যেভাবে পারিস আটকা। নইলে আমি কিন্তু একটা খারাপ কিছু করে ফেলবো।" কাঁদতে কাঁদতে বলল রিমি।
রাফিদ বেশ অবাক হল। তার বোন একটা ছেলেকে ভালোবেসে জীবন শেষ করে দেয়ার কথা ভাবছে। এতোটা নরম মনের মেয়ে রিমি কখনোই ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই রিমি অনেক স্ট্রং আর বেশ স্পষ্টভাষী ছিল। ছটফটে, দূরন্ত, মিষ্টি আর খুবই দয়ালু মনে অধিকারী এই মেয়ে।
সেই তুলনায় রাফিদ বেশ চুপচাপ আর শান্ত।
রাফিদ উঠে এসে বোনের মাথায় হাত রাখে। বলে,
"তুই ভাবিস না। এতদূর থেকে সময়মতো আসতে যখন পেরেছি তখন একটা কিছু ব্যবস্থাতো করবোই।
ফোন হাতে নিয়ে রাফিদ একটা নাম্বার ডায়াল করে।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশেরজন ফোন রিসিভ করল।
"হ্যালো,,, "