Type Here to Get Search Results !

দ্বিধা (পর্ব_৫)


 ১৩.

খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে রুম্পার। গতরাতেও অনেকটা রাত অবধি পড়েছে। এত সকালে ঘুম ভাঙ্গার কথা না৷ তবুও ভাঙলো। অগত্যা শুয়ে না থেকে বিছানা ছাড়লো ও। জানালা খুলতেই একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা ছুঁয়ে গেল। ভোরের আলো, হাওয়া, নরম রোদ সবই মিষ্টি। পরীক্ষার টেনশন, পড়ার চাপ সবকিছুকে এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়ে মনটা কেমন ভালো হয়ে গেল।
আজকাল আপুর সাথে দেখাও হচ্ছে না, কথাও হচ্ছে না ঠিকমতো। রাতদিন বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে থেকে থেকে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে একদম। লক্ষ্য শুধু একটাই। একটা দুর্দান্ত ভালো রেজাল্ট তার চাই। যে করেই হোক।
অনেক পড়াশোনা করবে, ভালো একটা চাকরি করবে, কত স্বপ্ন ওর। আপুকে দেখে দেখে নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটা স্পৃহা জেগে উঠেছে ওর সুপ্ত মনে।
আপুর বিয়ে হবে ভাবতেই রুম্পার মনে দুধরনের অনুভূতি খেলা করে। একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া টের পায় সাথে আনন্দও হয়।
আজ একবার বের হবে। এডমিট কার্ড আনতে কলেজে যেতে হবে। শায়লা ফোন দিয়েছিল।
শায়লা রুম্পার বেস্ট ফ্রেন্ড। স্কুল থেকেই ওরা একসাথে বন্ধু হয়ে আছে। রূম্পা তেমন মিশুক নয়। কথাও কম বলে। ইন্ট্রোভার্ট যাকে বলে। স্কুল থেকে কলেজ অবধি ওর একজনই বন্ধু। শায়লা।
ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে একটু পড়তে বসল। হাতে আরো ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। তারপর কলেজে যাবে।
....
অসহ্য গরমে মনে হচ্ছে গায়ের চামড়া ছিলে যাবে। সেই সাথে রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য। আর বোনাস হিসেবে জ্যামতো আছেই।
ফোনস্ক্রিন অন করে সময় দেখে নিল রাফিদ। দশটার সময় তন্ময়ের সাথে দেখা করার কথা। এখন বাজে ৯:৪০। সময়মত পৌঁছাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেকদিন পর রিক্সা দেখে চড়ার শখ হয়েছিল। এবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একটা ক্যাব নিয়ে নিলে অন্তত এই কড়া রোদের আঁচ থেকে বাঁচা যেত।
পাক্কা বিশ মিনিট পর জ্যামটা নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল রিক্সা। গন্তব্যের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভূত হল। পরে যেতে যেতে রিক্সা চালকের সিটটা ধরে কোনরকমে বেঁচে গেল। ব্যাপারটা কী হল সেটা বুঝে ওঠার আগেই দেখতে পেল রিক্সার সামনে একটা মেয়ে পড়ে আছে। লোকজন জটলা পাকিয়ে গেছে এবং অতি উৎসাহী কিছু মানুষ রিক্সাওয়ালাকে মারতে উদ্যত হয়েছে। হঠাৎ দেখল মেয়েটার হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে পারলো এই রিক্সায় ধাক্কা লেগেই মেয়েটা পড়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতেই রাফিদ চট করে নেমে পড়ল রিক্সা থেকে। ক্রুদ্ধ জনতার হাত থেকে মোটামুটি রিক্সাওয়ালাকে উদ্ধার করা গেল। এবার মেয়ের দিকে নজর দিতেই দেখতে পেল মেয়েটা যন্ত্রণায় চোখ মুখ খিঁচে আছে। রাফিদ এগিয়ে গেল।
"কিছু মনে না করলে আমার সাথে একটু হাসপাতালে চলুন। প্লিজ! "
মেয়েটি মাথা নেড়ে জানালো সে যাবে না। বোঝা গেল তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে এই অবস্থা।
" আমাকে একটু কলেজে যেতে হবে। আজকে আমার এডমিট কার্ড দেবে।" মিনিমিন করে অনেকটা শোনা যায় না এমন ভয়েসে কথাগুলো বলল মেয়েটি।
রাফিদ একটু ভেবে নিয়ে ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "উঠে আসুন। আমি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। ট্রিটমেন্ট শেষে আমি নিজেই পৌঁছে দেবো কলেজে।"
একটু ইতস্তত করে মেয়েটা। অপরিচিত একজনের সাথে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে কি না ভাবছে।
"উঠে আসুন, প্লিজ। ভয় নেই।"
এবার রাফিদের দিকে তাকিয়ে যেন ভরসা খুঁজে পেল। রাফিদের বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে উঠে এল। সেই একই রিক্সায় চড়ে মেয়েটাকে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল রাফিদ।
তন্ময় ভাইকে একটা ফোন করা দরকার। উনি হয়ত এসে বসে আছেন। ভাবতেই ফোন দিয়ে এদিকের পরিস্থিতিট বুঝিয়ে বলল।
তন্ময় ওদিক থেকে জানালো ও অফিস থেকে বের হতে পারেনি এখনো। সুতরাং, চাপ না নিয়ে ধীরে সুস্থে কাজ সেরে নিতে বলল।
হাতের একপাশে অনেকটাই কেটে গেছে। তিনটে স্টিচ দিতে হল। একটা এক্সরে ও করানো হলো। ভয় আর দুশ্চিন্তায় মেয়েটার মুখ একদম এতটুকু হয়ে গেছে। সামনে এক্সাম। দ্রুত যদি এই হাত না সারে তাহলে কপালে দু:খ আছে।
"চিন্তা কোরো না। সেরে যাবে।" রাফিদ যেন বুঝতে পারলো মেয়েটার মনের কথা। তাই আস্বস্ত করল।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটা সি এন জি ডেকে নিয়ে তাতেই উঠে পড়ল দুজন। গন্তব্য কলেজ। মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েই তন্ময়ের অফিসে চলে যাবে একেবারে। বাইরে দেখা করার চেয়ে এটাই ভালো মনে হল আপাতত।
"এতকিছুর মধ্যে তোমার নামটা জানা হলো না। তুমি বলছি বলে কিছু মনে করো না। আমার চেয়ে তুমি অনেকটাই ছোট। তাই মুখ দিয়ে শুরুতেই তুমি বেরিয়েছে। ওটা আর আপনিতে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। " বলল রাফিদ।
মেয়েটা একটু হাসলো৷
"আমি রুদমিলা খালিদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক সাহায্য করলেন। " আবারো সেই মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল মেয়েটি।
রাফিদ একটু হাসলো। সৌজন্যমূলক হাসি।
কলেজের সামনে এসে গাড়ি থামলো। রূম্পা নেমে গেল। একই গাড়ি নিয়ে রাফিদ আবার চলে যাবে। তবু ভদ্রতাবশত একবার নেমে দাঁড়ালো।
রূম্পা গেটের মধ্যে প্রবেশ করতেই রাফিদ চলে যাবার উদ্দেশ্যে ঘুরে দাঁড়ালো।
----------
১৪.
লাঞ্চ শেষ করে ফোনটা হাতে নিল শম্পা। মোবাইল ডাটা অন করতেই ম্যাসেঞ্জারে একটা ম্যাসেজ এসে ঢুকলো।
আইডি নেইমটা দেখে ম্যাসেজটা ওপেন করলোনা। প্রিভিউতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল।
"আমার সাথে কী একটু দেখা করা যায়? প্লিজ! "
আদনানের আইডি থেকে ম্যাসেজটা এসেছে। আদনান আশরাফ চৌধুরী নামটা দেখে ওটা আর খুলে চেক করলো না শম্পা। মনটা কেমন যেন দমে গেলো। অনেকটা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে হাসফাস করার মত অনুভূতি হচ্ছে। বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা হৃদপিণ্ডটা যেন বহুগুণ ওজন বেড়ে গেছে। এই ভার সহ্য করা বেশ দূরুহ।
না। এই অনুভূতিকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কিছুতেই না।
চট করে উঠে দাঁড়ালো শম্পা। এমনিতেই আজকে আমজাদের সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল। শপিং এ যাবে। ওকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে অন্বেষা অবাক হয়ে তাকালো।
"কী ব্যাপার? আজ এত তাড়াতাড়ি বেরুচ্ছো? কোথাও যাবে?" জানতে চাইলো অন্বেষা।
মনেমনে বিরক্ত হলেও ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি টেনে নিয়ে বলল, "হ্যাঁ। একটু কাজ আছে। আসছি।" বলেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। অন্বেষার কৌতুহলী প্রশ্ন থেকে বাঁচতেই একরকম পালিয়ে যাওয়ার মতো।
আমজাদকে বেশ পাঙচুয়াল মনে হল। একদম সময়মত এসে হাজির। শম্পাকে দেখেই একটু হাসলো।
:কেমন আছেন, রেহনুমা?
:এইতো ভালো। আপনি?
:আমিও আছি।
:তুতুল কেমন আছে?
:তুতুল ও ভালো আছে।
"চলুন আগে একটু চা কফি কিছু খাওয়া যাক। অফিস থেকে বেরিয়েছেন নিশ্চয় টায়ার্ড। চা কফি কিছু খেলে হয়ত একটু রিফ্রেশ লাগবে।" বলল আমজাদ।
"না। আমি চা কফি খুব কম খাই। এই মুহুর্তে ইচ্ছেও করছে না। কাজ সেরে যত দ্রুত বাসায় যাওয়া যায় ভালো।" শম্পা আপত্তি জানিয়ে বলল।
"ঠিকাছে। চলুন তাহলে যাওয়া যাক। "
"হ্যাঁ, চলুন। তবে যেটা বলেছিলাম। আপনার কেনাকাটাটাই আজকে শেষ করুন। আমারটা পরে হবে। আপনি যেহেতু চাইছেন আপনার কেনাকাটা আমার পছন্দে হোক সুতরাং আমিই সবকিছু চুজ করে দেব।" বলল শম্পা।
"আপনি কী আমার সাথে কম্ফোর্টেবল ফিল করছেন না?" আমজাদ জানতে চাইলো।
"আসলে আমি পরিবারের গন্ডির বাইরে গিয়ে কারো সাথে তেমন মিশিনি বা এভাবে আলাদা করে কারো সাথে সময় কাটাইনি। একারণে অনভ্যস্ততার কারণে আমি সহজ হতে পারছি না। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। " সরাসরি বলল শম্পা।
আমজাদ একটু অবাক হলো। আমজাদের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। রেহনুমাকে যখনই দেখত হয়ত খুব হাসছে নয়ত গল্প করছে। পুরো কলেজে দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটা কীভাবে এমন গম্ভীর হয়ে গেল ভাবতে অবাক লাগছে তার।
আমজাদকে চুপ করে থাকতে দেখে শম্পা বলল, "আমার কথায় আপনার খারাপ লেগে থাকলে স্যরি। কিন্তু, আমি হুট করে নিজেকে বদলে ফেলতে পারবো না। "
আমজাদ শুকনো কণ্ঠে বলল, "না, ঠিকাছে। "
কণ্ঠস্বরের এই নিরুত্তাপ শম্পা বুঝলো।
দুজনেই একসাথে শপিং মলে ঢুকে গেল।
রাস্তার অপর পাশ থেকে একজোড়া চোখ খুব ব্যথিত দৃষ্টিতে ওদের যাওয়াটা দেখল।
আদনান।
----
অফিসের ওয়েটিং রুমে এসে বসেছে তন্ময়। সাথে রাফিদ। রাফিদকে এই প্রথম সরাসরি দেখলো তন্ময়। তবে ফোনে কথা হয়েছে বহুবার।
"আমি বাবাকে আপনার ব্যাপারে সরাসরি বলতে চাই। যেহেতু একটা বিয়ে আটকাবো সুতরাং একটা লজিক্যাল রিজন অবশ্যই দেখাতে হবে। সেক্ষেত্রে কোন মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে বা ঠুনকো কোন এক্সকিউজ না দেখিয়ে আমি সরাসরি আপনাদের সম্পর্কের কথাটাই জানাতে চাই।
এক্ষেত্রে আপনার মত কী?" বলল রাফিদ।
"আমার কোন আপত্তি নেই। এই স্টেপটা আমিও নিতে পারতাম যদি শুরু থেকেই পরিস্থিতি অনুকূলে থাকতো। কিন্তু এত হুট করে ঘটে গেল সবকিছু আমি নিজেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। প্লিজ, তুমি একটু হেল্প করো।" বলল তন্ময়।
রাফিদ একটু মুচকি হাসলো।
"নো টেনশন। বাবার সাথে যদিও একটু ঝামেলা আছে আমার, তবু রিমির জন্য জান লাগিয়ে দিয়ে চেষ্টা করবো। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে দেখলাম।" কথাটা বলেই তন্ময়ের দিকে তাকালো রাফিদ। দেখলো তন্ময়ের মুখটা বিষন্নতার ছাপ পড়েছে। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফিদের দিকে।
তন্ময়ের এই দৃষ্টি, এই বিষন্নতা রাফিদকে স্বস্তি দিয়েছে। রাফিদ চেয়েছিল তন্ময়ের মধ্যে সেই আকুতিটুকু দেখবে যেটা রিমির মধ্যে দেখেছে।
আরো কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর রাফিদ উঠলো। কথা দিয়ে গেল সে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে বাবাকে রাজি করানোর জন্য।
---
ফোন স্ক্রিনে আদনানের নাম দেখে বশিরুল্লাহ বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন। রিসিভ করবেন কি করবেন না ভাবতে ভাবতেই লাইন কেটে গেল। আবার রিং হল। এবার বশিরুল্লাহ ফোন রিসিভ করলেন।
:হ্যালো।
:হ্যালো। মামা।
:হ্যাঁ, বল।
:তুমি আমজাদের সাথে শমুর বিয়ে ঠিক করেছ?
বশিরুল্লাহ অবাক হলেন। আমজাদের ব্যাপারে আদনান জানলো কীভাবে?
"হ্যাঁ, তুই কীভাবে জানলি? আমজাদকে তুই চিনিস নাকি? "
আদনান কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, "তুমি কি জানো আমজাদের স্ত্রী সুইসাইড করেছিল? "
-------
আদনানের সাথে কথা বলার পর বশিরুল্লাহ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনে হচ্ছে নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। পরপর দু গ্লাস পানি খেয়েও যেন তৃষ্ণা মিটছে না। এক্ষুনি একবার শম্পার সাথে কথা বলা দরকার। তার আগে কি একবার নিজের বোনকে ফোন দেবেন?
উফ! মাথা একদমই কাজ করছে না। হাত পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। একবার উঠে দাঁড়িয়ে আবার ধপ করে বসে পড়লেন। এই মূহুর্তে শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া বেশ ভারী মনে হচ্ছে। টানা ১০ মিনিট ঝিম ধরে বসে রইলেন। একটু ধাতস্ত হয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করলেন মিসেস খালিদের নাম্বার। প্রথমেই বোনের সাথে কথা বলতে হবে।
------
১৫.
আজিজুদ্দিন আহমেদ চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছেন রাফিদের দিকে। তিনি যতোটা না অবাক হয়েছেন তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন আঘাত।
রিমি একটা ছেলেকে ভালোবাসে এটা তিনি দেশে মেয়ের পাশে থেকে ও জানতে পারেননি। তাকে এই তথ্য জানাতে ছেলেকে সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে দৌড়ে আসতে হল। অথচ মেয়ের সাথে উনার সম্পর্ক বরাবরই বন্ধুর মত ছিল। তারপরও এতবড় একটা ব্যাপার উনি জানলেন না।
"বিয়ের প্রোপোজাল এল যখন তখন ও কিছু বলল না কেন? এতোটা দূর গড়াবার পর কেন বলতে হল? " কণ্ঠে নিরুত্তাপ ধরে রেখে বললেন আজিজুদ্দিন আহমেদ।
"আব্বু, এইসব ক্ষেত্রে মনে একটা দ্বিধা কাজ করে ফ্যামিলিতে মেনে নেবে কি নেবেনা। সেই দ্বিধা থেকে ভয় ঢুকে যায় মনে। ও বলতে চেয়েও পারেনি। এখনোতো কিছুই হয় নি। ওদের কাছে এপলোজাইস করে নিলেইতো হয়ে যাচ্ছে। " বলল রাফিদ।
"আমাকে শেখাতে এসো না রাফিদ। একটা অ্যাপোলজিতেই সব মিটে যায় না। আত্মীয় স্বজন জেনে গেলে তখন নানান কথা উঠে। পরিবারের সম্মান নষ্ট হয়। "
"আব্বু, লোকজন দু একদিন কথা বলবে তারপর ভুলে যাবে। কিন্তু তোমার মেয়ে সুখী হবে? লোকজনের কথা, সম্মান নষ্ট হওয়া এইসবের চেয়ে রিমির সুখটাই বড় করে দেখা উচিৎ না? :
"তুমি আমাকে উচিৎ অনুচিৎ শেখাতে এসো না। আমি তোমার চেয়ে কিছু কম বুঝি বলে মনে হয় না। "
এই পর্যায়ে রাফিদ উঠে এসে বাবার পাশে বসল। আচমকা বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
"আব্বু, প্লিজ! আমার উপর আর রাগ করে থেকো না। প্লিজ! "
এমন সময় কোত্থেকে রিমিও দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল।।
ঘটনার আকস্মিকতায় আজিজুদ্দিন আহমেদ হতভম্ব। ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে জাহানারা বেগম ও আঁচলে চেপে ধরেছেন চোখে।
মুহুর্তের মধ্যে দৃশ্যপট চেইঞ্জ হয়ে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতিতে রুপান্তরিত হল।
আজিজুদ্দিন আহমেদ ভাবলেন, সারাটা জীবন এই ছেলে মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। আর আজ সেই হাসি আনন্দকে ছাপিয়ে তাদের দু:খগুলো এতবড় হয়ে গেছে! তিনি কিছুই টের পেলেন না কেন?
ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, "তন্ময়কে বলিস আমার অফিসে এসে যেন একটু দেখা করে যায়। আমি আগে ছেলের সাথে কথা বলতে চাই। তারপর অন্যকিছু ভাববো। "
তারপর উঠে চলে গেলেন। উনার চোখেও পানি চলে এসেছে। সেটা ছেলে মেয়েদের দেখাতে চান না। লজ্জার ব্যাপার হবে।
জাহানারা আহমেদ স্বামীর পিছু পিছু চলে গেলেন।
-------
রুম্পাকে দেখে রীতিমতো বুক কেঁপে উঠলো মিসেস খালিদের। হাতে ব্যান্ডেজ। চোখে মুখে ফ্যাকাশে ভাব। তিনি দৌড়ে এলেন মেয়ের কাছে।
"কী ব্যাপার? কীভাবে হল এইসব? "
"তেমন কিছু না আম্মু। রাস্তায় একটা রিক্সার সাথে ধাক্কা লেগেছিল। এই সামান্য একটু কেটে গেছে। "
"সামান্য? সত্যি করে বলত কতখানি ব্যথা পেয়েছিস? "
মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে মিথ্যে বলতে আর ইচ্ছে হলনা।
"তিনটা স্টিচ পড়েছে আম্মু।" মুখ কাচুমাচু করে বলল।
মিসেস খালিদ এবার বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কীভাবে কি হল জেনে নিলেন ধীরে ধীরে। তারপর এক গ্লাস গরম দুধ খাইয়ে মেয়েকে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ পর বশিরুল্লাহ এলেন। ভাইয়ের বিষন্ন চেহারা দেখে মনে মনে কু ডাক ডেকে উঠলো মিসেস খালিদের। কিছুক্ষণ আগে ভাইয়ের ফোন পেয়েই সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারলেও নিজে থেকে কিছু জানতে চাইলেন না। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো।
"এক গ্লাস পানি দাও আপা। " বললেন বশিরুল্লাহ।
পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ভাইয়ের পাশে এসে বসলেন।
এক চুমুকে পানিটা শেষ করে বোনের দিকে তাকালেন। কিভাবে কথাটা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, "শুনলাম আমজাদের প্রথম স্ত্রী সুইসাইড করেছিল।"
মিসেস খালিদ চমকে উঠলেন।
:কার কাছে শুনলি?
:আদনান ফোন দিয়েছিল।
:আদনান! (অবাক হলেন মিসেস খালিদ।)
:হ্যাঁ, আপা। ছেলেটা আদনানের পূর্ব পরিচিত। একসাথে পড়াশুনা করেছে।
:আদনান হঠাৎ তোকে এই কথা বলল কেন আজ?
:আদনান আজকে ওদের দুজনকে একসাথে দেখেছে। আমজাদকে দেখেই চিনতে পারে। তারপর ই আমাকে ফোন দিয়ে জানালো।
মিসেস খালিদ কেমন দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন।
বশিরুল্লাহ বুঝলেন বোনের চোখের ভাষা।
বললেন, "না আপা। আমার মনে হয়না আদনান বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরকম একটা কথা বলবে। ও শমুকে ভালোবাসে। পেতে চাইছে। কিন্তু তাই বলে নোংরা কোন খেলা খেলবে না। এইটুকু বিশ্বাস ওকে আমি করি। "
"তাহলে, এখন কী করবি?" উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন মিসেস খালিদ।
"বুঝতে পারছি না। "
আদনানকে একবার আসতে বল। সামনাসামনি একটু কথা বলা দরকার। আমার মেয়েটার জীবনে অনেকদিন পর একটা সুখের হাতছানি দেখা গেছে। সেটা একটা উড়ো কথায় নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।
--------
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরোজা খুলে দিলেন মিসেস খালিদ। মেয়েকে দেখে একটু হাসলেন।
ক্লান্ত পায়ে ঘরে ঢুকতেই শম্পার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সম্মুখে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে।
...............
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.