Type Here to Get Search Results !

দ্বিধা( পর্ব..৩)


 ৬.

ফোন অনেক্ষণ ধরে রিং হচ্ছে। মিসেস খালিদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চেক করে দেখলেন চারটা মিসড কল। তারমধ্যে দুটো বশিরুল্লাহর। আর দুটো আননোন নাম্বার। তিনি বশিরউল্লাহর নম্বরে কল ব্যাক করলেন।
:হ্যালো।
:কেমন আছো বড়াপা?
:এইতো ভালো আছি। তোর কী খবর?
:আমিও আছি ভালো। শমুর সাথে আর কথা হয়েছে?
:না রে। কয়েকটা দিন যেহেতু সময় চেয়েছে তাই আমিও আর ওকে নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে ডিস্টার্ব করতে চাইনি।
:বড়াপা,,,, একটা কথা।
:হ্যাঁ, বল। কী হয়েছে?
:আদনান দেশে ফিরে এসেছে। শুনলাম আর ফিরে যাবে না।
কথাটা শুনেই মিসেস খালিদের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
:ভালোইতো। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। অনেকদিনতো হল। আর কতদিন বাইরে বাইরে থাকবে।
:সেতো ঠিক আছে। কিন্তু, ব্যাপারটা হল ও ফিরেছে একা। সাথে বউ বাচ্চা কাউকেই আনেনি। তারমানে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে।
:অযথা নেগেটিভ কিছু ভাবার দরকার কী? হয়ত ও আগে এসে গেছে, বউ বাচ্চা পরে আসবে।
:না। আমার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। আরেকটা কথা কানে এল। শুনলাম ও নাকি শমুর অফিসের ঠিকানা যোগাড় করছে।
এই কথাটা শুনে মিসেস খালিদ চমকে উঠলেন। এতদিন পর এইরকম একটা কথা শুনবেন তিনি ভাবতেই পারেন নি। এক সময় দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মিনু আপা মানে আদনানের মা শম্পাকে খুব আদর করতেন আর দুষ্টুমি করে প্রায়ই বলতেন, "এই লক্ষ্মীসোনা মেয়েটাকে আমার ছেলের বউ বানাবো। " কত হাসি আনন্দের স্মৃতি ছিল ওদের সাথে। ধীরে ধীরে সব বদলে গেল।
মিসেস খালিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বশিরুল্লাহ বোনের মনের অবস্থাটা বুঝলেন। বললেন,
"চিন্তা কোরোনা আপা। এই ব্যাপারটা আমি নজরে রাখবো। "
ফোন রেখে মিসেস খালিদ চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তায় মনটা ছেয়ে গেল। আদনান যদি শম্পার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শমুর মন কি আবার অস্থির হয়ে যাবে?
------------------
"ভাইয়া, তুমি এটা কী বললে?" অবাক হয়ে জানতে চাইলো শম্পা।
আদনান সাহস করে কথাটা বলে ফেললেও এখন আর শম্পার দিকে তাকাতে পারছে না। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল শম্পা শান্ত দৃষ্টিতে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
"শমু, এই এত বছরে আমি তোকে একদম ভুলতে পারিনি। তোকে ছেড়ে যেবার প্রথম দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলাম তোর সেদিনকার নীরব বিষন্ন দৃষ্টিটা আমার মনে এমনভাবে গেঁথে গেছে আমি চাইলেও সেটা মন থেকে সরাতে পারিনা। চোখ বন্ধ করলেই তোর সেই মুখটা মনে ভাসে। কি এক দূর্বিষহ যন্ত্রণায় আমার দিন কাটে আমি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। " বিষন্ন কণ্ঠে বলল আদনান।
"তুমি দেশে এলে অথচ আমার সাথে দেখা পর্যন্ত করলে না। বিয়ে করলে। তোমার সংসার হল। যতদূর জানি তোমার একটা ছেলেও আছে। দিব্যি বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার করে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলে আর এখন এসে তুমি এইসব বলছ?" বলল শম্পা।
"সেসময় তোর সাথে দেখা করার মত কোন পরিস্থিতি ছিল না। আমি যেদিন দেশে ফিরলাম সেদিনই আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল মেয়ে দেখতে যাবে বলে। মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখি ওরা মোটামুটি ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেলেছে। সেই অনুষ্ঠানেই আব্বু আম্মু অনেকটা ব্ল্যাকমেইল করে এক রকম জোর করেই আমার সাথে রেহনুমার আকদ পড়িয়ে দেয়। " বলল আদনান।
শম্পা এবার চমকে উঠলো। "রেহনুমা!"
ফোস করে শ্বাস ফেলে আদনান বলল, "হ্যাঁ। ওর নাম ও রেহনুমা। এই নামটাও একরকম শান্তনার মত কাজ করেছে আমার জীবনে। কিন্তু, ঐ যে আমাদের দুইজনের মাঝখানে সর্বক্ষণ একটা দেয়ালের মত হয়েছিলি তুই। নীরবে। সেই দেয়ালটা আর সরলোই না।
ওর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে শমু। আমি আর ওখানে ফিরবোনা বলেই একবারে চলে এসেছি। "
শম্পা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সামনে বসে থাকা মানুষটা যেমন ওর বিষাদমাখা অতীতের একটা অংশ ঠিক তেমনই ওর জীবনে সুখের যত স্মৃতি তার ও একটা অংশ জুড়ে আছেন তিনি। তবুও সেই বিষাদের দিনের দু:সহ সময়টাতে যে মানুষটা ওকে একলা করে দিয়েছিল, ওর পৃথিবীটা শূণ্য করে দিয়ে চলে গিয়েছিল তাকে কী আবার সে গ্রহণ করতে পারবে? সেতো আবার চলে যেতে পারে।
কিছু ভাবতে পারছেনা আর। দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরল শম্পা। মনের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করছে।
হঠাৎই চট করে উঠে দাঁড়ালো শম্পা। আদনান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। শম্পা একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, "তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছ ভাইয়া। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে সেটা পরের দিনের জন্য বোঝা হয়ে যায়। তুমি ফিরে আসবে বলে কথা দিয়েছিলে। ফিরে এসেছ। কিন্তু ভুল সময়ে।
আমাদের গল্পটা শেষ। বাসায় বেড়াতে এসো। তোমাকে দেখলে মা খুশি হবেন।" বলেই দ্রুত পায়ে কফিশপ থেকে বের হয়ে গেল।
কফিশপ থেকে বের হয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করল। ফোন কানে লাগিয়ে ওপাশের রিং শুনছে শম্পা। ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোন রিসিভ করল,
হ্যালো!
------------------
৭.
আমজাদের ঠিক সামনেই বসে আছে শম্পা। আমজাদ শম্পাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। সেদিনের তুলনায় আজকে মেয়েটাকে বেশ মলিন আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। হয়ত সারাদিনের কাজের চাপের কারণে এমনটা দেখাচ্ছে। যদিও এই ক্লান্তির ছাপ মেয়েটার সৌন্দর্যকে একটু ও ম্লান করে দিতে পারেনি। একটা নিখুঁত মুখচ্ছবিতে যেন দুটো পটলচেরা চোখ কেউ সুন্দরভাবে এঁকে দিয়েছে। এই মুখচ্ছবির সাথে গায়ের শ্যামলা রংটা খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে। আমজাদের মনে হল এই মেয়ের গায়ের রঙ ফর্সা হলে এই মুখের সাথে যেন সেটা মানাতো না।
ওরা বসে আছে একটা রেস্ট্যুরেন্টে। ওয়েটার এসে দুটো কফি রেখে যেতেই আমজাদ একটু নড়েচড়ে বসল।
শম্পাও কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তারপর ও শম্পাই প্রথম মুখ খুলল। আদনানের সামনে থেকে উঠে এসে শম্পা আমজাদকে ফোন করে দেখা করার কথা জানায়। আমজাদ একটু অবাক হলেও আপত্তি করেনি। লোকেশন জেনে নিয়ে ঠিক সময়মত চলে এসেছে।
"আপনাকে এভাবে আসতে বলার জন্য আমি দু:খিত। আসলে আমি সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরী করতে চাইছি না। এই কারণে আপনার সাথে আমার কয়েকটা কথা বলে নেয়া দরকার।। এতদিন বিয়ে করবোনা জেনেই আমার পরিবার চুপ ছিল। এখন যেহেতু একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সুতরাং ওরাও বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে আমার সিদ্ধান্ত জানার জন্য। আর একারণেই আপনাকে হুট করে এভাবে ডেকে আনা। আমি খুব আশা করব আপনি যেন কিছু মনে না করেন।"
একটানা কথাগুলো বলে থামল শম্পা।
"আমি কিছু মনে করিনি। আপনি কি বলতে চান বলুন।" বলল আমজাদ।
"আমি সরাসরি কয়েকটা কথা জানতে চাইবো। আপনার সাথে যেদিন দেখা হল আপনি বলেছিলেন নিজের প্রয়োজন ছাড়াও মূলত আপনি মেয়ের জন্যেই বিয়েটা করতে চাইছেন। আমিতো চাকরিজীবী। সুতরাং, সারাদিন আমাকে কর্মসূত্রে ঘরের বাইরেই কাটাতে হবে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো আমি সারাদিন মেয়েকে সময় দিতে পারছি না। আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, চাকরি ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এই যে সারাদিন মেয়েকে সময় দিতে পারবো না এই ব্যাপারটা নিয়ে পরবর্তীতে কোন ঝামেলা বা অশান্তি সৃষ্টি হবেনাতো?" কথাগুলো বলেই আমজাদের দিকে সরাসরি তাকালো শম্পা।
"প্রথমত, আপনি একজন কর্মজীবী এটা জেনেও আমি যেহেতু আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি সুতরাং বুঝতেই পারছেন আপনার চাকরি করা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। যেহেতু সমস্যা নেই সেহেতু আপনাকে বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিতে আমি অবশ্যই বাধ্য করবো না। এটা সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে।।
আর দ্বিতীয়ত, কর্মজীবী বাবা মায়ের সন্তানেরাও কিন্তু বড় হচ্ছে,মানুষ হচ্ছে। যেসব সন্তানের বাবা, মা উভয়েই কর্মজীবী তারাওতো সন্তান লালন পালন করছেন। আপনার কাছে আমার শুধু এটুকুই চাওয়া থাকবে আমার মেয়েটাকে আপনি মায়ের আদর, ভালোবাসা দেবেন। একটু মা হয়ে যত্ন করবেন। সর্বোপরি আপনি ওর মা হয়ে উঠবেন। আমি জানি এটুকু আপনি পারবেন রেহনুমা।" বলেই আমজাদ মুচকি হাসলো।
"এতোটা বিশ্বাসের সাথে কিভাবে বলছেন?" বলল শম্পা।
"সেটা অন্য একদিন বলব। আপাতত আপনার বাকি কথাগুলো শোনা যাক।" মুচকি হেসে বলল আমজাদ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শম্পা আবার বলতে শুরু করল।
"আমি যেহেতু আমার ঘরের বড় সন্তান সেহেতু বাবা মারা যাবার পর থেকে পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। দায়িত্ব বলতে সেটা শুধু অর্থনৈতিক নয় আমি সার্বিক দায়িত্বের কথা বলছি। একজন অভিভাবক যেভাবে সংসারের সব দিক সামলে হাল ধরেন অনেকটা সেরকম। এই দায়িত্ব আমি আজীবন পালন করে যাবো। আমার পরিবারের যখনই আমাকে প্রয়োজন হবে আমি নির্দ্বিধায় ছুটে যাবো। এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার কোন আপত্তি থাকবেনা তো?" জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো শম্পা।
"রেহনুমা, আমি আপনার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছি। তবে হ্যাঁ, সব বিষয়ে জানা আর সে বিষয়গুলোকে মেনে নেয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। তাই হয়ত আপনি এই ব্যাপারগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে নিচ্ছেন।
এই ব্যাপারে আমার কখনো আপত্তি থাকবে না। বরং আমাকেও আপনার পাশে পাবেন। এমন নয় যে একটা নতুন সম্পর্ক হতে যাচ্ছে বলে আবেগী হয়ে কথা দিয়ে ফেলছি। আমি নিজেই আমার পরিবারের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ছিলাম, আছি। সুতরাং, আপনাকে বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তবুও যেহেতু আপনি জানতে চেয়েছেন তাই, কথা দিচ্ছি আমার দিক থেকে কোন অসহযোগিতা করবোনা। "
আমজাদের কথায় শম্পা কিছুটা স্বস্তি পেল। আমরা মুখে যত যাই বলি না কেন কি হবে না হবে সেটা সব সময় পরিস্থিতিই ঠিক করে দেয়। তাই আর মনে কোন দ্বিধা রাখতে চায় না শম্পা।
হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায় সে। ওকে দাঁড়াতে দেখে আমজাদও উঠে দাঁড়ায়। শম্পা একটু হেসে 'আসি' বলে বিদায় নিয়ে নেয়। যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ায়। ফিরেই দেখে আমজাদ এখনো তাকিয়ে আছে। ওকে উদ্দেশ্য করে বলল, "আজকে দেখা হয়ে গেল বলে শুক্রবারের প্রোগ্রামটা যেন ক্যান্সেল করে দেবেন না। ওটা কিন্তু ফিক্সড আছে। "
কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।
১৬ টা রিং হওয়ার পর ১৭ বারে এসে তন্ময় ফোনটা রিসিভ করল। তন্ময়ের ফোন না ধরাটা রিমির জন্য এতই কমন হয়ে গেছে যে ফোন রিসিভ করেছে দেখেও রিমি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না।
অপর প্রান্তে তন্ময় ও চুপ হয়ে আছে। কথা বলতে বলতে রাত পার করে দেয়া দুজন প্রেমী আজ আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
"নীরবতা ভেঙে রিমি বলল, তন্ময়, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে এনগেইজমেন্ট।"
---------------
৮.
শম্পা আর বশিরুল্লাহ প্রায় একসাথেই এসে ঘরে ঢুকলো। আমজাদের সাথে দেখা করে বেরিয়েই শম্পা মামাকে ফোন করে বাসায় আসতে বলে দিয়েছে জরুরি কথা বলবে বলে।
দুজনকে একসাথে দেখে মিসেস খালিদ একটু অবাক হলেন। অফিস থেকে মেয়ের ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। ফোন করতে নেবেন এমন সময় ওরা এসে ঘরে ঢুকলো।
"আম্মু, তুমি একটু চা বসাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আর তন্ময় কী ফিরেছে? ফিরলে ওকেও একটু ডাকো।" বলেই শম্পা নিজের রুমে চলে গেল।
মিসেস খালিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চাইলেন কী ব্যাপার? বশিরুল্লাহ ও মাথা নেড়ে বোঝালেন উনিও কিছু জানেন না।
প্রায় ১০/১৫ মিনিট পর শম্পা ড্রইং রুমে এসে সবার সাথে বসল। মিসেস খালিদ আর বশিরুল্লাহ সোফায় বসে আছেন। তন্ময় এখনো ফেরেনি।
মা আর মামার উৎসুক দৃষ্টি দেখে শম্পা হেসে ফেললো। ওদের চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুজনকেই পানিশমেন্ট দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
একটু দম নিয়ে শম্পা বলল, "আমি এই বিয়েতে রাজি আছি। "
কথাটা শুনেই সামনে বসে থাকা দুই ভাই বোনের চোখ উজ্জ্বল হল, মুখে হাসির রেখা দেখা গেল।
"তবে আমার একটা শর্ত আছে।" বলল শম্পা।
"কী শর্ত?" জানতে চাইলেন বশিরুল্লাহ।
"আমি চাই বিয়েটা খুব সাদামাটা ভাবে হোক। লোক ডাকাডাকি, খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন হৈ হুল্লোর এসব আমার পছন্দ নয়। খুব সাধারণভাবে খুব কাছের অল্প কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়েটা হোক। এবং আমি চাই তাড়াতাড়িই সেটা হোক।" বলেই থামল শম্পা।
"বিয়ে সাদামাটাভাবে হোক সমস্যা নেই। কিন্তু তাড়াহুড়ো কেন করছিস সেটা একটু বলবি আমাকে?" বশিরুল্লাহ জানতে চাইলেন।
"মামা, বহুদিনের জমে থাকা ভয় এবং দ্বিধাকে সরিয়ে আমি অনেক কষ্টে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে এই বিয়েটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চাইনা আমার সেই সাহসে কোন কারণে ভাটা পড়ুক। আমি চাইনা কোন কারণে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলার মত মুহুর্ত সৃষ্টি হোক।" বলল শম্পা।
বশিরুল্লাহ ভাগ্নীর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলেন। মনেমনে ভাবলেন, আদনানের সাথে দেখা হয়ে যায়নিতো!
"ঠিকাছে। আমি আজই আমজাদের সাথে কথা বলে নেব। ও আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। তোমরাও এদিকটা গোছগাছ করে নাও। প্রস্তুতি শুরু করে দাও।" বশিরুল্লাহ বললেন।
আলাপচারিতার এক ফাঁকে কলিং বেল বেজে উঠলো। শম্পা উঠে গিয়ে দরোজা খুলতেই ছোট ভাইকে দেখে চমকে উঠলো। বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়।
শম্পার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। সামনে থেকে সরে গিয়ে ভাইকে ঘরে ঢোকার জন্য জায়গা করে দিয়ে নিজেও পিছু পিছু এল।
ড্রইং রুমে মা আর মামাকে বসে থাকতে দেখে তন্ময়ও বসে পড়ল।
"কি ব্যাপার? খুব গল্প হচ্ছিল মনে হয়?" বলল তন্ময়।
"হ্যাঁ, একটা সুখবর আছে তোর জন্য। এখন শুনবি নাকি ফ্রেশ হয়ে এসে শুনবি।" হাসিমুখে বললেন বশিরুল্লাহ।
"এখুনি বল মামা। অনেকদিন হলো কোন ভালো খবর শুনি না। বল। শুনে একটু কান জুড়োই।" বলেই হাসল তন্ময়।
শম্পা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। ভাইয়ের এরকম বিধ্বস্ত চেহারা আর দেখেনি সে।
"আমাদের শমুর বিয়ে। শমু এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহের দিকে বিয়ের একটা তারিখ ফিক্সড করে ফেলবো।" বললেন বশিরুল্লাহ।
তন্ময় চট করে তাকালো বোনের দিকে। শম্পা তাকিয়েই ছিল ভাইয়ের দিকে। চোখাচোখি হতেই একটু হাসলো। তন্ময় উঠে এসে হঠাৎ শম্পাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আর কেউ না বুঝলেও শম্পা বুঝলো এটা কিসের কষ্ট অশ্রু হয়ে ঝরছে। বেচারা ছোট ভাইটা নিজের মনের সাথে একরকম যুদ্ধ করেই এই কটাদিন হাসিমুখে চলাফেরা করছিল।
দুদিন আগে শম্পার ম্যাসেঞ্জারে 'জোছনার ফুল ' নামে একটা আইডি থেকে ম্যাসেজ আসে। আননোন আইডি থেকে ম্যাসেজ এলে শম্পা সেসব কদাচিৎ খুলে দেখে। সেদিন কি মনে করে ম্যাসেজটা খুলতেই বিশাল একটা ম্যাসেজ চোখে পড়ল। কেউ একজন ম্যাসেজের নাম করে মোটামুটি একটা রচনা লিখে পাঠিয়েছে। ম্যাসেজটা না পড়ে রেখেই দিচ্ছিল কিন্তু তন্ময়ের নামটা দেখে চোখ আটকে গেল।
রচনার সারমর্ম কি ছিল সেটা বোঝাই যাচ্ছে নিশ্চয়ই। হুট করে রাজি হয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজটা সেরে ফেলার পেছনে মূল কারণ ছিল এটা। ম্যাসেজটা পেয়েই সেদিন আমজাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিল শম্পা। আজকে আদনানের সাথে দেখা হওয়াটা সেই ব্যাপারটাকে আরেকটু ত্বরান্বিত করে এগিয়ে দিল।
ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শম্পা কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, "এবার সব ঠিক হয়ে যাবে তনু। আর কাঁদিস না। "
শম্পার কথায় তন্ময়ের হুঁশ ফিরলো যেন। চট করে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। এরকম একটা ছেলেমানুষী কান্ড করে ফেলাতে তন্ময় একটু লজ্জা পেয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে একরকম দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যে যার ঘরে চলে গেল। রুম্পার সামনে এইচ এস সি এক্সাম। রাতদিন এক করে কেবল পড়ছে। মিসেস খালিদ রাত জেগে মেয়েকে সঙ্গ দেন। তন্ময় আর শম্পা শুয়ে পড়ে।
ফিরে গিয়ে বশিরুল্লাহ আমজাদের সাথে কথা বললেন ফোনে। সবকিছু শুনে আমজাদ জানালো এই ব্যাপারে ওর পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নেই। কয়েকদিন পরেই দুই পরিবার একসাথে বসে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে নেবেন। আমজাদের সাথে কথা শেষ করে বশিরুল্লাহ বোনকে ফোন করে সব জানিয়ে দিলেন। শম্পাও শুনলো।
ঘুমোবার প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় গেল শম্পা। ফোনটা সাইডে রেখে বিছানায় মাথা রাখতেই টুং শব্দে জানান দিল নোটিফিকেশন এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করে দেখল হোয়াটসঅ্যাপে আমজাদের টেক্সট। ম্যাসেজটা ওপেন না করেই প্রিভিউতে দেখে নিল। ছোট্ট একটা টেক্সট।
"Thank you ❤️"
কোন রিপ্লাই না দিয়ে ডাটা অফ করে ফোনটা পাশে রেখেই ও চোখ বন্ধ করল।
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.