Type Here to Get Search Results !

দ্বিধা(পর্ব:২)

 



পর্ব_২ 


৩.

পরপর দুবার নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠতেই তন্ময় ফোনটা হাতে নিল। ম্যাসেঞ্জারে দুটো ম্যাসেজ এসে ঢুকলো। স্ক্রিনে 'জোছনার ফুল' নামের আইডিটা শো করছে। বিরক্তিতে তন্ময়ের ভ্রু কুচকে উঠল। এটা রিমির ফেইক আইডি। মূল আইডিটা ডিএক্টিভেটেড রাখলে রিমি এই ফেইক আইডিটা খুলে বসে থাকে। উদ্দেশ্য তন্ময়ের গতিবিধি সম্পর্কে আপডেট থাকা। 

এই মুহুর্তে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজগুলো চেক করার কোন ইচ্ছেই নেই। তাছাড়া তন্ময়ের বেশ ঘুম পাচ্ছে। ফোনটা ফ্লাইট মুডে রেখে দিয়ে তন্ময় শুয়ে পড়ল। কারণ ও জানে ম্যাসেজ সিন না করলে রিমি অনবরত ফোন দিতে থাকবে। এই মুহুর্তে রিমির সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই। বলবেই বা কী? আপু বিয়ের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা না জানা পর্যন্ত রিমিকে কয়েকটা দিন এভয়েড করতে হবে। ভাবতে ভাবতেই তন্ময় ঘুমিয়ে পড়ল। 


রিমি তন্ময়ের গার্লফ্রেন্ড। গার্লফ্রেন্ড শব্দটা এক্ষেত্রে কেমন হালকা শোনাচ্ছে। সম্পর্কের গভীরতাকে ঠিকঠাক ভাবে প্রকাশ হতে দিচ্ছে না। বলা ভালো ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। সম্পর্কটা হুট করে তৈরি হয়নি। রিমিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মূলত রিমিই প্রথম হাত বাড়িয়েছিল তন্ময়ের দিকে। 

তন্ময় একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিত মাঝেমধ্যে। মূলত কোচিং সেন্টারটি পরিচালনা করত তন্ময়ের কয়েকজন বন্ধুরা মিলে। সেই কোচিং সেন্টারেই ছাত্রী ছিল রিমি। তবে কোচিং সেন্টারে পড়ার সময়কালীন ওদের মধ্যে কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি, সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল আরো পরে। সেসময় তন্ময় রিমিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য না করলেও রিমি তখন থেকেই তন্ময়কে পছন্দ করতে শুরু করেছিল।।

কিভাবে ওদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটা আপাতত বলা বাহুল্য। এখন মূল ব্যাপার হল রিমিকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। তন্ময় এই ব্যাপারটা জেনেও নির্বিকার। রিমি কৈফিয়ত চাইলেই তন্ময় বলেছিল আপুর জীবনটা গুছিয়ে না দিয়ে তন্ময় নিজের বিয়ের কথা এখন ভাববে না। যদিও আপু বিয়ে করতে চাইছে না তবুও ওরা সবাই একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখবে। এই ব্যাপারগুলো রিমির অজানা নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ও রিমিকে বাধ্য করছে তন্ময়কে বিয়ের জন্য চাপ দিতে। রিমিও নিরুপায়। 


রাতের বেলা আমজাদকে হোয়াটস আপে টেক্সট দিয়ে ১০/১৫ মিনিট অপেক্ষা করেছিল শম্পা। এরপর অপর পাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের আজানের একটু পর নোটিফিকেশন এর টুংটাং শব্দে শম্পার ঘুম ভেঙে গেল। ভুলবশত মোবাইল ডাটা অন রেখেই ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করতেই আমজাদের নামটা চোখে পড়ল। 

" শুভ সকাল।

স্যরি। একটু আগেই আপনার ম্যাসেজটা দেখলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোবার অভ্যেস। আপনার ফোন নাম্বরটা আমি সেইভ করে রাখছি। নক দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। " 


ম্যাসেজটা সিন করেই শম্পা ফোন রাখতে যাবে এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে একটা রিকুয়েস্ট চোখে পড়ল। স্ক্রিনে অদ্ভুত একটা আইডি নেইম শো করছে। জোছনার ফুল। 

----------

৪.

আজ বেশ ভোরে ভোরে ঘুম ভাঙ্গার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের বেশ অনেকটা আগেই অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিতে পেরেছে শম্পা। মাথায় সুক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। ঘুম কম হলে ওর এমনটা হয় মাঝেমাঝে। এক কাপ চা নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসে। স্নিগ্ধ একটা ভোর বেলা বাড়ার সাথে সাথে কতোটা ব্যস্ততার রূপ ধারণ করতে পারে তা রাস্তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। জীবনটা কেমন যন্ত্রের মতো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। একটা গৎবাঁধা ছকেই চলছে রোজ। কোন পরিবর্তন সেই। 


ফোনটা হাতে নিয়ে আমজাদকে একটা টেক্সট পাঠালো। 

"আজ বিকেলে একটু সময় হবে? "

টেক্সট পাঠিয়েই আমজাদের ডিপিটাতে চোখ পড়তেই একটা মিষ্টি চেহারার বাচ্চার ছবি দেখতে পেল। ক্লিক করতেই ছবিটা স্পষ্ট হল। ভীষণ মিষ্টি আর আদুরে একটা মুখ। বড় বড় চোখ মেলে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অজান্তেই শম্পার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। 

একটু ভেবে নিয়ে আবার টাইপ করতে শুরু করল

"সুযোগ হলে আপনার মেয়েটাকেও নিয়ে আসবেন। আমি ওর সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। আজকে সম্ভব না হলে আরেকদিন ফিক্সড করুন। আমাকে জানাবেন। " 

আগের টেক্সটটা এখনো সিন হয়নি। স্ক্রিন অফ করে ফোনটা বেগে রেখে শম্পা বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। 

------------

লাঞ্চ আওয়ারে খাওয়াটা শেষ করে ফোন হাতে নিল তন্ময়। ডাটা অন করতেই হুড়মুড় করে অনেকগুলো ম্যাসেজ ঢুকল সাথে। সবকটাই 'জোছনার ফুল ' থেকে। তন্ময় বিরক্ত হল। ম্যাসেজে কি আছে সেটা দেখার ইচ্ছে নেই বলা ভুল হবে। মূলত তন্ময় ভয় পাচ্ছে। ওর কেবলি মনে হচ্ছে ম্যাসেজ ওপেন করলেই দেখবে রিমির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই জাতীয় কিছু। অপারগতা মানুষকে কতোটা অসহায় করে দেয় সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও।

একটা সময় রিমির টেক্সট এর জন্যেই অপেক্ষা করত। ডাটা অন করতেই রিমির টেক্সট দেখতে পেলে মন ভালো হয়ে যেত। আর এখন...... একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা ড্রয়ারে রেখে দিল। 


রিমির সাথে তন্ময়ের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল একদম সাদামাটাভাবে। একই বাসে চড়ে তন্ময় যাচ্ছিল ইউনিভার্সিটিতে আর রিমি যাচ্ছিল কলেজে। পূর্বের চেনাজানার সূত্র ধরে তন্ময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রিমিকে নিজের সিটটা ছেড়ে দেয়। বাসের হেল্পার ভাড়া চাইতে এলেই বিপত্তি বাধে। তন্ময়ের ওয়ালেট হাওয়া। বাসের ভীড়েই কেউ কার্য সম্পাদন করে ফেলেছে। তন্ময় বেশ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। এইসময় ওকে উদ্ধার করল রিমি। একটা একশ টাকার নোট বাস হেল্পারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দুজনের ভাড়া রাখুন। শুধু তাই নয় পরের স্টপে নেমে যাওয়ার সময় তন্ময়ের হাতের ভেতর আরো একশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, "বাড়ি ফিরতে হবেতো, নাকি?" বলেই মুচকি হেসে নেমে গেল। 

এরপর প্রায়ই ওদের দেখা হত, গাড়িতেই। পাশাপাশি বসতে পারলে টুকটাক কথাও হত। এরপর ফোন নম্বর আদান প্রদান, ফেইসবুকে এড হওয়া, রোজ ম্যাসেঞ্জারে টুকটাক চ্যাট করা ধীরে ধীরে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ালো যে প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও ফোনে কথা বলা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালে একটা গুড মর্নিং টেক্সট সারাদিনের এনার্জি যোগাচ্ছিল আর রাতে ঘুমোবার আগে একটা গুড নাইট টেক্সট সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। দুদিক থেকেই সমান আবেদন থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তন্ময় মাঝেমধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিত বা রিমি দুকদম এগিয়ে গেলে তন্ময় সাথে চলার পরিবর্তে এক কদম পিছিয়ে থাকতো ইচ্ছে করেই। 


তবুও যা হওয়ার তা হয়েই যায়। রিমির চোখ ভরা আকুতি আর আন্তরিক ইচ্ছার কাছে একটা সময় তন্ময় ধরা দিলেও নিজের পরিবার পরিস্থিতি আর নিজের সীমাবদ্ধতা রিমির কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিল। সবকিছু মেনে নিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে রিমির অসুবিধা হয়নি কিন্তু পরিস্থিতি সব সময় অনুকূলে থাকে না। একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে রিমিকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছে। না পরিবারকে কিছু বোঝাতে পারছে না তন্ময়কে। তন্ময়তো একরকম যোগাযোগ বন্ধই করে দিয়েছে। তন্ময়ের ব্যাপারটা রিমি বুঝলেও নিজের এরকম একটা বিপদের সময়ে তন্ময়ের কাছ থেকে ও আরেকটু সহযোগিতা আশা করেছিল। তন্ময়কে এভাবে নির্বিকার থাকতে দেখে কিছুটা অভিমান ও জড়ো হয়েছে মনে। 

-----


নোটিফিকেশন টোন পেয়ে ফোন হাতে নিল শম্পা। স্ক্রিন অন করতেই দেখতে পেল হোয়াটসঅ্যাপে আমজাদের রিপ্লাই এসেছে। 

"শুধু আমি হলে আজকেই দেখা হয়ে যেতে পারতো। তুতুলসহ সাক্ষাৎ আজকে সম্ভব না। ও বাসায় নেই। বেড়াতে গিয়েছে। কালই চলে আসবে। এক কাজ করা যায়। পরশু শুক্রবার। আপনার ও অফিস ছুটি থাকবে। সেদিন যদি আপনার কোন অসুবিধা না থাকে তাহলে দেখা হতে পারে। " 


শম্পা বুঝতে পারলো আমজাদের মেয়ের নামই তুতুল। শম্পা রিপ্লাই দিল। 

"ঠিকাছে। শুক্রবারেই দেখা হোক। তবুও মেয়ে সহ হোক। "

সাথে সাথে আমজাদের রিপ্লাই এল।

"অপেক্ষায় রইলাম। " 


ফোনটা ব্যাগে রেখে শম্পা অফিস থেকে বেরোলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ওর নাম ধরে ডাকলো। পেছন ফিরেই শম্পা বেশ বিস্মিত হল।সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার সাথে প্রায় ৮ বছর পর দেখা। 

-------

৫.

চোখের সামনে হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত কাউকে দেখলে আমরা অনেকসময় ভাষা হারিয়ে ফেলি। ৮ বছর পর আদনানকে সামনে পেয়ে শম্পার ও ঠিক একই অবস্থা। অবাক হয়ে তাকিয়েই রইল। 


"কী ব্যাপার? এতোটাও বদলে যাইনি যে একেবারে চিনতেই পারবি না।" বলল আদনান। 

আদনানের কথায় সম্বিত ফিরে পেল শম্পা। ঠোঁটে একটা জোড়পূর্বক হাসি টেনে রেখে জানতে চাইলো, "কেমন আছো, ভাইয়া? "

ভাইয়া ডাকটা শুনে আদনান মনেমনে একটু দমে গেল। শম্পার মুখে ভাইয়া ডাকটা আদনান তখন ও পছন্দ করত না আজও কেন জানি ভালো লাগলো না। 

"ভালো আছি।" শুকনো মুখেই জবাব দিল আদনান।

"তুমি হঠাৎ এখানে? দেশে কবে এলে?" জানতে চাইলো শম্পা। 


"দেশে এসেছি এইতো গত সপ্তাহে। এখানে এসেছি তোর সাথে দেখা করতে। আরো আগে আসতাম। অফিসের ঠিকানাটা যোগাড় করতে এইটুকু সময় লেগে গেল।" আদনান বলল। 


শম্পা এবার চূড়ান্ত অবাক। সে যারপরনাই বেশ বিস্মিত। 

"আমার সাথে দেখা করতে এসেছ!?" এই প্রশ্নে সেই বিস্ময় প্রকাশ ও পেল বেশ ভালোভাবে। 

" আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হলে বাসায় আসতে পারতে। বাসায় আসোনি কেন? তোমাকে দেখলে মাও খুশি হত।" বলল শম্পা। 


আদনান একটু আমতা আমতা করে বলল, 

"খালামনির মুখোমুখি হতে সাহস পাচ্ছিলাম না রে। এখানে দাঁড়িয়েই কি কথা বলবি? চল একটু কোথাও বসি। " 


"এখানে কোথায় বসব? তারচেয়ে বাসায় চলো। বাকিদের সাথে ও দেখা হয়ে যাবে।" বলল শম্পা। 


"প্লিজ! বাকিদের সাথে অন্য আরেকদিন দেখা হবে। আপাতত চল এখানে কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসি। অফিস থেকে বেরিয়েছিস তোর নিশ্চয়ই ক্ষিধেও পেয়েছে। চল দুজন মিলে একটু কফি টফি কিছু খাই।" বেশ আকুতি নিয়েই বলল আদনান। 


শম্পা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। যতই স্বাধীনভবে চলাফেরা করুক তবুও একটা নিজস্ব গন্ডির মধ্যে সে নিজেকে ধরে রাখে। সেই গন্ডি থেকে কদাচিৎ ই বের হয়। ৩৩ বছর বয়সী একটা মেয়ে একেতো অবিবাহিত হয়ে আছে বলে লোকজনের নানান কথার শেষ নেই তার উপর কোন একটা ছল ছুঁতো পেলেতো হয়েই গেল। এমন নয় যে লোকজনের কথায় ওর খুব একটা কিছু যায় আসে। লোকের কথা কান দিয়ে ঢোকালেও মন পর্যন্ত সেটা পৌঁছাতে দেয়না আর এই ব্যাপারটা অনেক কষ্ট করেই রপ্ত করেছে ও। কিন্তু, মা এসব ব্যাপারে ভীষণ কষ্ট পায়।

এইসব কারণেই আদনানের সাথে কোথাও বসতে শম্পার বেশ বাধ বাধ ঠেকছে। 

আদনান এখনো উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। 

একটু কিছু ভেবে নিয়ে শম্পা বলল,

"চলো সামনে একটা কফিশপ আছে। ওখানে বসি। " বলেই সামনে পা বাড়ালো। 


আদনান শম্পার খালাতো ভাই। তবে আদনানের মা শম্পার আপন খালা নয়। শম্পার মায়ের চাচাত বোন। আদনান বয়সে শম্পার চেয়ে ৪ বছরের বড় হলেও ছোটবেলায় প্রায় একসাথে খেলেধুলে ওরা বড় হয়েছে। শম্পার কিশোরী মনে ফাগুনের দমকা হাওয়াটা প্রথম আদনানই লাগিয়েছিল। তখন শম্পাদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। বাবাও বেঁচে ছিলেন। দুই পরিবারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক ছিল। আদনান শম্পার খেলার সাথী হলেও ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতেই শম্পা বুঝলো আদনানের দৃষ্টি আর আগের মতো নেই। ভাই, বন্ধুত্ব সব কিছু ছাড়িয়ে ও আরো কিছু যেন দাবী করে। তার ঐ ঘোর লাগা দৃষ্টিতেই সেটা প্রকাশ পায়। 


কিশোরী বয়সের সেই সময়টাতে নিজের প্রতি আদনানের এই মুগ্ধতা শম্পা বেশ উপভোগ করত। কখনো দুপুরে, কখনো বিকেলে বা কখনো সন্ধ্যারাতে হুটহাট করে আদনান বাসায় চলে এলে শম্পার মনটা ভালো লাগায় ভরে যেত। একসাথে বসে গল্প করা, আদনানের মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকানো, হুটহাট ওর মাথায় হাত রাখা, আদর করে চুল এলোমেলো করে দেয়া সবকিছুতেই যেন শম্পা আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো। শুধু শম্পার মুখে ভাইয়া ডাকটা শুনলেই আদনান রেগে যেন। রাগ করে বলত, "খবরদার ভাইয়া ডাকবি না আমাকে। "

শম্পা খিলখিল করে হেসে উঠত আর বলত, "ভাইয়াকে ভাইয়া বলবনা তো কি বলব? তুমিতো ভাইয়াই। "

আদনান কপট রাগের ভঙ্গিতে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতো আর শম্পা এসে কানে ধরে ওর রাগ ভাঙ্গাতো। ওদের মধ্যে তথাকথিত কোন প্রেমের সম্পর্ক তখনও গড়ে ওঠেনি বা কেউ কাউকে মুখ ফুটে বলেই নি ভালোবাসে। সেটা হয়েছিল আরো পরে। তবুও এক অমোঘ ভালো লাগার টানে দুজনেই একে অপরকে মনে মনে চাইতে শুরু করেছিল। একটা রঙিন বসন্তের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে ওরা কল্পনায় ভেসে যেত অনেকটা দূর। 


এরপর স্বপ্নের মত কেটে গেল অনেকটা সময়। আদনান আর শম্পা ডুবে রইল পরষ্পরের ভালোবাসায়। হঠাৎ করেই শম্পার বাবার ব্যবসায় ধ্বস নামলো। আর্থিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে তথাকথিত কিছু আত্মীয় স্বজনের চেহারাও পালটে যেতে শুরু করল। তাদের মধ্যে আদনানের ফ্যামিলিও ছিল। আদনানের মধ্যে কোন পরিবর্তন না এলেও ওর বাবা মায়ের মধ্যে এল বিরাট পরিবর্তন। বিশেষ করে আদনানের বাবার মধ্যে।হুটহাট আদনানের শম্পাদের বাসায় যাওয়াটা উনি আর ভালো চোখে দেখছেন না কিন্তু আদনানকে দমিয়েও রাখা যাচ্ছে না। এরমধ্যে একদিন শম্পা জানতে পারলো আদনানকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুনে ভীষণ মন খারাপ হলেও শম্পা বুঝতে পারছে পরিস্থিতি এখন আর আগের মতো নেই। এখন এমন অনেক কিছুই ঘটবে যা কল্পনার ও অতীত। 

আদনানের প্রবল আপত্তি ওর বাবার একগুয়েমির কাছে টিকতে পারেনি। তবে চলে যাবার আগে একবার লুকিয়ে এসে শম্পার সাথে দেখা করে গেল। যাবার বেলায় শম্পার হাত ধরে বারবার বলে গেল, "আমি যোগ্য হয়ে ফিরে আসবো তোর কাছে। " শম্পা সেদিন একদম চুপ হয়েছিল। নিজের জন্য আদনানকে ফিরে আসতে বলার মত অধিকারটুকু কী ওর আছে? সেই দ্বিধা নিয়েই কোন কথা না বলে চুপচাপ থেকেই বিদায় জানিয়েছিল আদনানকে। আদনান চলে যাবার কয়েক মাস পরেই একদিন হঠাৎ শম্পার বাবা মারা গেলেন। এবার শুধু আত্মীয়স্বজন নয় পুরো পৃথিবীটাই যেন এক লহমায় অন্যরকম হয়ে গেল। কত কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেসব ভাবতেও আর ইচ্ছে করে না। 


আদনান কথা রাখতে পারেনি। যোগ্য হয়েছে ঠিক তবে আর শম্পার কাছে ফিরতে পারেনি। একবার দেশে এসেছিল ঠিক কিন্তু শম্পার সাথে দেখা হয়নি। লোকমুখে শুনেছে আদনান বিয়ে করেছে এবং বউ নিয়ে আবার বাইরে চলে গেছে। 

না, সেদিন শম্পার আর মন খারাপ হয়নি। ততদিনে আঘাত নিতে নিতে ভোতা হয়ে যাওয়া ওর মনটা অনেকটাই অনুভুতিহীন হয়ে গেছে। 


"শমু।"

ডাকটা শুনেই চমকে তাকালো শম্পা। কতবছর পর আদনান ওকে শমু বলে ডাকলো। 

প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। এরমধ্যে ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল। 


"তুমি কিছু বলবে বলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ। এখন কিছুই বলছ না।" বলল শম্পা। 

"তোর ও কিছু বলার নেই? অন্তত কোন অভিযোগ?" বলল আদনান। 

"নাহ্! অভিযোগ থাকবে কেন? কোন অভিযোগ নেই। আর কিছু বলার ও নেই। প্রতিটা সম্পর্ক একেকটা গল্প তৈরি করে, সেই সম্পর্কের সাথে সাথে গল্পটাও শেষ হয়ে যায়। আমাদের গল্পটা শেষ হয়ে গেছে ভাইয়া। আর কোথাও কিচ্ছু বাকি নেই। "

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আদনান বলে উঠলো,

"আমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া যায় না শমু? "

শম্পা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল আদনানের দিকে। 



Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.