পর্ব :১
আমজাদ আর শম্পা মুখোমুখি বসে আছে। দুজনেই হালকা নার্ভাস। প্রায় ৭/৮ মিনিট হতে চলল দুজনের কেউই মুখ খুলছেনা। আমজাদ এর মধ্যেই দু গ্লাস পানি শেষ করেছে। অস্বস্তি কাটাতে শম্পা হালকা চোখ ঘুরিয়ে আমজাদের অফিসটা দেখছে। অফিসের ডেকোরেশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা রুচিশীল, মনেমনে ভাবলো শম্পা।
"অফিসের এই সাজসজ্জা এক বন্ধু ডিজাইন করেছে", বলল আমজাদ। শম্পা চমকে তাকালো।
"আপনি আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন তাই জানালাম।" ঠোঁটে একটা সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে রেখে পুণরায় আমজাদ কথাটা বলল।
যাক, অন্তত কথা বলা শুরু করা গেল এই ভেবে শম্পা হালকা একটা নি:শ্বাস ফেলল।
"আমার সম্পর্কে হয়ত কিছুটা জেনেই এসেছেন। তবুও আমি একবার নিজেই পরিচিত হই। আমি আমজাদ আনোয়ার। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। এম এ পাস করেছি তবে আমি ব্যাবসা শুরু করেছি পড়াশুনা চলাকালীন সময় থেকেই। একসময় বেশ টানাপোড়েনের মধ্যদিয়ে গেলেও এখন আমি একজন সফল ব্যবসায়ী বলতে পারেন। আমি বিপত্নীক এবং আমার সাড়ে চার বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে। মূলত তার জন্যেই এই বিয়ের সিদ্ধান্তটা নেয়া। আমারো যে একজন স্ত্রীর প্রয়োজন নেই সেটা বলব না কারণ সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমার স্ত্রী মারা গেছে দুবছর হল। আমি আরো আগেই বিয়ে করতে পারতাম চাইলে। কিন্তু অন্য একটা মেয়ে আমার স্ত্রী হতে পারবে ঠিক আমার সন্তানের মা হতে পারবে কি না সেটা নিয়ে আমি খুব দ্বিধায় ছিলাম। এখনো যে দ্বিধা নেই তা নয় তবু মেয়ের জন্যেই এই সিদ্ধান্তটা নিলাম। আমার বক্তব্য আপাতত এটুকুই। এবার আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।"
শম্পা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এইসব তথ্য শম্পার অজানা নয়। তবুও শুনছিল মনযোগ দিয়ে। আর মনেমনে ভাবছিল ভদ্রলোক অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।
শম্পাকে চুপ থাকতে দেখে আমজাদ আবারো মুখ খুলল।
"দেখুন, আপনার আপত্তি থাকলে আপনি আমাকে সেটা সরাসরি জানাতে পারেন। আমি কিছু মনে করবনা। এর ওর মাধ্যমে কথা চালাচালি হওয়ার চাইতে আমি সরাসরি কথা বলতে স্বস্তিবোধ করি। সুতরাং, আপনার যা বলার আমাকেই সরাসরি বলুন।"
এবার শম্পা একটু নড়েচড়ে বসল। ইতস্তত করতে করতে বলল, "আপনাকে দেখেছি পর্যন্ত কেমন চেনা চেনা লাগছে। আপনাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? "
আমজাদের মুখে একটা সুক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল। হাসিটা ধরে রেখেই বলল, "দেখে থাকতে পারেন। "
এবার শম্পা সোজা হয়ে বসল। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করল।
"আমার সম্পর্কে আপনিও হয়ত অনেক কিছুই জেনেছেন শুনেছেন। কতটুকু কি শুনেছেন বা জেনেছেন জানিনা আমি নিজে থেকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
আমি রেহনুমা খালিদ শম্পা। তিন ভাই বোনের মধ্যে আমিই সবার বড়। আমার বাবা খালিদুজ্জামান একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল ছিলাম আমরা। কোন কিছুর অভাব বোধ করিনি কখনো অন্তত বাবা থাকতে সেটা হতে দেয় নি। কিন্তু, হঠাৎ করেই বাবার ব্যবসায় বেশ লস হয়ে গেল এবং ধীরে ধীরে অনেক কিছুই চেইঞ্জ হয়ে গেল। আমি যখন অনার্স প্রথম বর্ষে একদিন হঠাৎ আমার বাবা মারা গেলেন। হার্ট এটাকে। এরপর থেকেই জীবনের নানা রকম কঠিন দিক আমাদের দেখতে হয়েছে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমি পড়ালেখা শেষ করলাম এবং আমার ভাগ্যই বলব খুব দ্রুত আমার একটা চাকরি ও হয়ে গেল। এর আগে আমি টিউশনি করে পড়ার খরচ চালিয়েছি, সংসারে মাকে কিছুটা সহযোগিতা করেছি। ছোট দুই ভাইবোনকে মানুষ করা, সংসারে আর্থিক চাহিদা পূরণ করা সব মিলিয়ে নিজের দায়িত্ব পালনের প্রতি আমি এতটাই ঝুঁকেছিলাম বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেই পারতাম না। একটা দ্বিধা আমার মধ্যেও কাজ করত। আমি চলে গেলে আমার পরিবারের কী হবে? বিয়ের পর আমার ফ্যামিলিকে ফিনানশিয়ালি সাপোর্ট দেয়া নিয়ে আমার হাজব্যান্ড এর সাথে কোন ঝামেলা হবে কি না, এইসব ভেবে ভেবেই দ্বিধাটা কেমন যেন ভয়ে পরিণত হল। একসময় অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসত। মা ও খুব চাইতেন আমার একটা সংসার হোক কিন্তু আমি কেন যেন পারলামই না। "
এইটুকু বলা শেষ হতেই আমজাদ এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল শম্পার দিকে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে পানিটুকু নিয়ে একচুমুকে শেষ করে নিল।
"এরপরের ব্যাপারগুলো ছিল আরো কঠিন।" বলতে শুরু করল শম্পা। এবার শম্পার কন্ঠে বিষন্নতার ছোঁয়া পেল আমজাদ। আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্মুখে বসে থাকা প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেয়েটির দিকে।
"বিয়ের উপযুক্ত বয়সী একটা মেয়ে বিয়ে না করে থাকাটা আমাদের সমাজে অনেক কঠিন একটা ব্যাপার। আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীরা শুরুর দিকে প্রচুর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসলেও আমার অনাগ্রহে সবকিছুতে ভাটা পড়ে যায় একসময়। এরপর শুরু হয় নানারকম কানাঘুষা। আমার হয়ত কোথাও সম্পর্ক রয়েছে, হয়ত কেউ প্রেমে ধোকা দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।"
এইটুকু বলেই সামনে রাখা টিস্যুর বক্স থেকে একটা টিস্যু নিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিল।
"এইসব অপ্রিয় ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। আপনি একটু রিলাক্স হোন।" বলল আমজাদ।
শম্পা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল," না, সময় এবং পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি অনেকটা বন্ধুহীন জীবন যাপন করেছি। অনেকসময় ইচ্ছে করলেও কারো সাথে দুটো কথা শেয়ার করতে পারিনি। কথাগুলো বলতে পেরে কিছুটা হালকা লাগছে।
কিছু মনে না করলে আমার একটা প্রশ্ন আছে মি. আমজাদ। "
"নিশ্চয়ই। নির্দ্বিধায় বলুন।" বলেই আমজাদ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেন।
"আপনার কেন মনে হল আমি আপনার মেয়ের মা হয়ে উঠতে পারবো?" প্রশ্নটা করেই উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল আমজাদের দিকে।
প্রশ্নটা শুনেই আমাজদের মুখে সুক্ষ্ম হাসি দেখা গেল। বলল," মনেই হচ্ছিল আপনি এই প্রশ্নটা করবেন। "
"সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?" শম্পা বলল।
"নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। " আমজাদ বলতে শুরু করল। "আপনার খোঁজ যিনি আমাকে এনে দিয়েছিলেন অর্থাৎ আপনার মামা বশিরুল্লাহ্ সাহেব তিনি আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত। আমরা ব্যাবসায়িক সূত্রে একসাথে কাজ করেছি অনেকদিন। কথায় কথায় তিনিই একদিন আপনার কথা বলছিলেন। আপনার ফ্যামিলির প্রতি এত দায়িত্ববোধ এর কথা শুনে আমার বেশ আগ্রহ হল আপনার সম্পর্কে আরেকটু জানার। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর উনি হঠাৎ কি মনে করে উনার ফোন গ্যালারি থেকে খুঁজে নিয়ে আপনার একটা ছবি দেখালেন আমাকে। ছবিটা দেখেই আমি আপনার মামার কাছে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখি। উনি ও বেশ আনন্দের সাথেই ব্যাপারটা দেখবেন বলে জানালেন। "
শম্পা এবার ভ্রু কুচকালো। একই সাথে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, "ছবি দেখে প্রস্তাব দিয়েছেন!?"
আমজাদ একটু গলাটা কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, "দুটো কারণে আমি প্রস্তাব দিয়েছি। তারমধ্যে একটা কারণ হল, আমি যতদুর জেনেছি আপনি আপনার ছোট ভাই বোনদের খুব ভালোবাসেন এবং অনেক যত্নে মানুষ করেছেন। কথাটা শুনে আমার কেন যেন মনেই হয়েছে আমার মেয়েটাকেও আপনি অনেক যত্ন করবেন। "
"আর আরেকটা কারণ?" উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল শম্পা।
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আমজাদ বলল, "এই কারণটা আমার ব্যক্তিগত। যদি আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা পরিণতি লাভ করবে বলে বুঝতে পারি বা সেরকম কথাবার্তা এগিয়ে থাকে তাহলে কারণটা আপনাকে জানাবো। "
শম্পার মধ্যে কৌতুহল থাকলেও আমজাদ যেহেতু এখুনি বলতে চাইছে না সুতরাং সেও আর শোনার জন্য জোর করল না। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময়টা দেখে নিল। প্রায় দু ঘন্টা যাবৎ সে আমজাদের অফিসে বসে আছে। শুরুতে কোন একটা রেস্ট্যুরেন্টে দেখা হওয়ার কথা থাকলেও শেষে আমজাদের কর্ডিয়াল রিকুয়েস্টে শম্পাকে এখানেই আসতে হল। হঠাৎ করেই আমাজাদের একটা জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়াতে এই কাজটা করতে হয়েছে। প্রথমে বিরক্ত হলেও এখানে এসে তেমন একটা খারাপ লাগছেনা। সাজানো গোছানো বেশ সুন্দর অফিস। বেশ নিরিবিলি। নির্বিঘ্নে আলাপ করা গেল।
শম্পা আরেকবার ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে আমজাদকে বোঝালো ও এবার উঠতে চায়। যেহেতু লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে আমজাদ শম্পাকে লাঞ্চ অফার করল। শম্পা বেশ ভদ্রতার সাথেই অপারগতা জানিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আমজাদ পিছু ডাকলো।
"যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ফোন নাম্বারটা কি পেতে পারি?"
শম্পা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ভেবে নিল। পরক্ষণেই সৌজন্যমূলক একটা হাসি দিয়ে আমজাদকে বলল, "আপনার একটা কার্ড দিন আমি হোয়াটস আপে নক দিয়ে দেব।"
আমজাদ খুশি হয়ে একটা কার্ড শম্পার হাতে দিয়ে দিল।
আমজাদের অফিস থেকে বের হয়ে শম্পা একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল। মধ্য গগণে সূর্য তার তেজোদ্দীপ্ত রূপ ধারণ করে সগৌরবে তপ্তদাহে পুরিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। মাথার উপর ঝকঝকে আকাশটাকে অন্য দিনের তুলনার যেন আজকে অনেক বেশি নীল দেখাচ্ছে। মানুষটার সাথে কথা বলে তাকে মোটেও কোন দমবন্ধকরা অনুভূতি পোহাতে হয়নি। অনেকটা সহজ আর অনেকটাই সাবলীল মনে হল। এই সাবলীলতা শম্পার মনের দ্বিধা অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে।
হাত বাড়িয়ে একটা রিক্সা থামিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। গন্তব্য এবার তার বাড়ি। অনেকগুলো উৎসুক মন সেখানে অপেক্ষা করছে।
--------------
২.
বাড়ি ফিরে শম্পা দেখল ছোট মামা বসে আছেন ড্রইং রুমে মায়ের সাথে। শম্পাকে ঢুকতে দেখেই হাসলেন একটুখানি। শম্পার মা তাকিয়ে আছেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। পাশেই বসে আছে ছোটবোন রূম্পা। তার চোখেও জিজ্ঞাসা। তিনজোড়া চোখকে আস্বস্ত করে ফ্রেশ হয়ে এসে কথা বলছি বলেই শম্পা রুমে ঢুকে গেল। হঠাৎ করেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করল যেন শরীরে। কী বলবে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা। কোন সিদ্ধান্ত ও নিতে পারছেনা।
বহুদিন ধরে যে দ্বিধা নিজের মধ্যে পুষে রেখেছে সেটা হুট করে সরে যাবার মত নয়। তারপরও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে আরেকটু সময় চায়।
ফ্রেশ হয়ে এসে শম্পা বসল সবার সাথে। মা ততক্ষণে টেবিলে খাবার দিয়েছে। একসাথেই খেতে বসল সবাই। শুনশান নীরবতা। চুপচাপ খাচ্ছে সবাই। ছোট মামাই মুখ খুললেন।
--"ছেলেটাকে কেমন লাগলো রে শমু?"
--"খারাপ লাগে নি।" শম্পার ছোট্ট জবাব।
--"এভাবে বললেতো হবে না। কেমন লেগেছে জানতে চাওয়ার মানে হল আমরা কথাবার্তা আগাবো কি না। ছেলেটা আমার অনেকদিনের পরিচিত। খুবই ভদ্র আর সৎ ছেলে। "
"উনার প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে তুমি কিছু জানো, মামা?" হঠাৎ শম্পা প্রশ্ন করল।
বশিরুল্লাহ সাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, "বলার মত বিশেষ কিছু নেই। কলেজে পড়ার সময় আমজাদের মা মারা যান। পরিবারে আমজাদ আর ওর বাবা এই দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। ঘর সংসার দেখাশোনা করার কেউ রইল না। কেউ কেউ আমজাদের বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য বললে আমজাদের বাবা সেটা আমলে নিলেন না। বললেন, ছেলের বিয়ের বয়সে আমাকে বিয়ে করতে বলার মানে কী? প্রয়োজন হলে আমার ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ আনব। সবাই আমজাদের জন্য পাত্রী দেখ।" আমজাদ কিছুটা আপত্তি করলেও সেটা ধোপে টিকল না। একরকম বাবার জোড়াজুড়িতেই ছাত্রাবস্থায় ওকে বিয়েটা করতে হয়েছিল। "
"উনার স্ত্রী মারা গেলেন কিভাবে?" শম্পা জানতে চাইল।
"যতটুকু জানি মেয়েটার জন্মের পর থেকে নানারকম অসুখে ভুগত। এরপর কি একটা অসুখে যেন দীর্ঘদিন ভুগে মারা গেল। সেসময় আমজাদের সাথে আমার যোগাযোগ হত খুব কম। তাই একদম খুটিনাটি জানি না। তবে ব্যবসায়িক সূত্রে পরিচিত এরকম এক বন্ধুর মুখে ওর স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য ফোনে সমবেদনা জানিয়েছিলাম।"
শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আমাকে আর দু একটা দিন সময় দাও তোমরা। এরমধ্যেই আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব। "
কথাটা বলার পরপরই শম্পা মায়ের চোখে আশাহত দৃষ্টি দেখতে পেল। ভাইয়ের মুখে ছেলের যে বর্ণনা শুনেছেন তাতে উনি হয়ত ভেবেছিলেন ছেলের সাথে দেখা করে এসেই শম্পা হয়ত বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাবে। মায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে শম্পা মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "আম্মু, এতদিনতো অপেক্ষা করলে। আর দুটো দিন নাহয় অপেক্ষা কর। প্লিজ! "
মেয়ে এভাবে বলবে সেটা মিসেস খালিদ বুঝতে পারেন নি। পরক্ষণেই মেয়ের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল। ম্লান হেসে বললেন, "কোন সমস্যা নেই। তুই চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নে।"
মেয়েটার একটা সংসার হবে এটা উনার অনেক দিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণের একটা আশার আলো দেখতে পেয়ে হয়ত তিনি একটু বেশিই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। যত যাই হোক মেয়ের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেবেন বলে মনে মনে ভেবে নিলেন তিনি।
-------------
"আপু আসব?"
নতুন কিছু বই কেনা হয়েছে। কোনটা আগে পড়তে শুরু করবে সেটা দেখার জন্যেই বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি শম্পা। দরোজার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই তন্ময়কে দেখতে পেল। মুখের হাসিটা চওড়া হল।
ইশারায় ভেতরে আসতে বলে বইগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলো। তন্ময় এসে খাটের এক কোণায় বসল।
তন্ময় শম্পার ছোট ভাই। তিন ভাইবোনের মধ্যে তন্ময় মেজ। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মাস তিনেক হল একটা চাকরিতে জয়েন করেছে।
তন্ময় কিছু না বলে শম্পার সরিয়ে রাখা বইগুলো টেনে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। শম্পা চুপচাপ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
"কিছু বলবি?" নীরবতা ভাঙলো শম্পা।
তন্ময় চোখ তুলে তাকালো। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, "তেমন কিছু না। এমনি এলাম তোমার সাথে গল্প করতে।"
শম্পা বুঝল আমজাদের সাথে আজকের সাক্ষাতের ব্যাপারেই তন্ময় জানতে এসেছে। শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরিবারের সবাই চাইছে ওর জীবনটা গুছিয়ে দিতে। ও নিজেই কেবল কোনদিক থেকে সাহস করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
শম্পার চোখেমুখে বিষন্নতা দেখে তন্ময়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বলল, "আপু, আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। জীবনটা তোমার। তুমি কিভাবে সেই জীবনটা কাটাবে সেটাও সম্পূর্ণ তোমার উপর। যদিও জীবনের সোনালী মুহুর্তগুলোর একটা অংশ তুমি এই পরিবারের ঘানি টানতে টানতেই শেষ করে দিলে। আমি বা আমরা তোমার জন্য একটা সুন্দর জীবন চাই ঠিকই কিন্তু সেটা তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বা তোমার উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়ে নয়। বিয়েটা তখনই কোরো যখনই মনে হবে তুমি বিয়ের জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করেছো। অন্যথায় কোন চাপ নেয়ার দরকার নেই। আমরা হয়ত আশায় বুক বেঁধে আছি তোমার একটা সুন্দর সংসার হবে তবুও আমি বলব তুমি খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে।"
কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। চলে যেতে যেতে আবারো ঘুরে দাঁড়ালো। বলল, "তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন আমাকে তোমার পাশেই পাবে।" বলেই তন্ময় বেরিয়ে গেল।
শম্পা অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাবতে লাগলো এইতো সেদিন ছোট ভাইটার জন্ম হল। শম্পা তখন ক্লাস ফাইভে। ছোট্ট একটা পুতুলের মতো বাচ্চাকে নিজের ভাই হিসেবে পেয়ে শম্পার সে কি খুশি। সারাদিন কোলে নিয়ে নিয়ে ঘোরা, ভাইটিকে যত্ন করে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো, একটু বড় হলে আদর করে পড়তে বসানো সবই শম্পা পরমানন্দে করত। সেই ছোট্ট আদরের ভাইটি কত বড় হয়ে গেল। গুরুজনের মত কি সুন্দর ভরসার জায়গা দিয়ে গেল। শম্পার চোখে পানি চলে এল। ওর একটা সিদ্ধান্ত এই প্রিয় মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাবে। ভাবতে ভাবতেই হ্যান্ডবেগটা খুলে আমজাদের দেয়া কার্ডটা হাতে নিল। নম্বরটা ফোনে সেইভ করে নিয়ে হোয়াটস আপে একটা টেক্সট পাঠালো